মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ে উল্লেখিত যেকোনো একটি ঘটনা সত্য প্রমাণের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। বইটির লেখক আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালিকে ছুঁড়ে দেওয়া এ চ্যালেঞ্জে হারলে বইটির বাকি সব লেখা সত্য হিসেবে মেনে নিবেন বলেও মন্তব্য করেন মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ।
বুধবার (২৬ জুন) সকালে বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে অভিযোগ তুলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বেশ কজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।
এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বলাকা প্রকাশনীর প্রকাশক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমি সিরু বাঙালিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তিনি যতকিছু লিখেছেন তার একটি ঘটনা আমাদের সবার সামনে সত্য প্রমাণ করুক। আমরা আপনার লেখা সত্য বলে মেনে নিবো। উনি যদি গল্প-উপন্যাস লিখেন, সেটা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করবেন তা মেনে নেওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায় আছে। একজনের মিথ্যাচারের কারণে আমাদের সবার গর্বের বিষয়টি ম্লান হয়ে যাবে? তাই আমরা সবাইকে আহ্বান করবো, যেকোনো তথ্য লেখার আগে তা অবশ্য ক্রস চেক করবেন।’
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ২৬৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, “তার নেতৃত্বাধীন ১৫১ নং গ্রুপে প্রশিক্ষণ নেওয়া ১২ জনসহ মোট ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ” এই ১৩ জনের নামের তালিকার মধ্যে আবার উনাইনপুরার বাসিন্দা সেই মনোজ বড়ুয়ার নাম আছে। অর্থাৎ সিরু বাঙালি একবার লিখেছেন, মানু তার গ্রুপ ছেড়ে আহমদ নবীর গ্রুপে চলে গিয়েছিল। পরে তিনিই আবার লিখেছেন, মানু তার গ্রুপে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গ্রুপটি আহমদ নবীর। ওনার নয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে মনোজ বড়ুয়া প্রকাশ মানু যে আবেদন করেছেন, সেখানে তিনি লিখেছেন, “১৫১ নং গ্রুপের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, আর তার কমান্ডার ছিলেন আহমদ নবী চৌধুরী। ” সেই ‘আহমদ নবী’ই ছিলেন গৌরাঙ্গ প্রসাদের অবর্তমানে ১৫১ নং গ্রুপের কমান্ডার। এদিকে যে গৌরাঙ্গ প্রসাদ মিত্রকে ১৫১ নং গ্রুপ কমান্ডার বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সিরু বাঙালি স্বীকার করেন না, তার কথা ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে।
২০ অক্টোবর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার সময় প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্র সঙ্গে ছিলেন জানিয়ে ২৭৬ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, “আমার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের জন্য খেতাব প্রদান করার কোনো ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্রের মতো মানুষদের কোনো যুদ্ধ ছাড়াই শুধু যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ভারত থেকে দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে পারার সাহসিকতার জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাব দিতাম। উক্তি করে সিরু বাঙালি তাঁর কমান্ডার গৌরাঙ্গ মিত্রকে অপমান করেছেন।’
একই পৃষ্ঠায় আবার সিরু বাঙালির ‘মিথ্যাচার’ উল্লেখ করে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রফেসর গৌরাঙ্গ মিত্রের মতো একজন নেহায়েত শান্তশিষ্ট, আগাগোড়া ভদ্রলোক কেন যে মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন একটি বিপদাপন্ন গেরিলাযুদ্ধে যোগ দিতে গেলেন, আমি অনেক গবেষণা করেও তার হদিস বের করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত।’ ১৫১ নং গ্রুপে কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃত আহম্মদ নবী চৌধুরীকে নিয়ে ২৭৮ পৃষ্ঠায় সিরু বাঙালি লিখেছেন, “২৮ অক্টোবর (১৯৭১) মঙ্গলবার আমরা বোয়ালখালী থানার জৈষ্ঠপুরা গ্রাম ত্যাগ করলাম। আমরা এবার পশ্চিম পটিয়ার দিকেই যাত্রা শুরু করলাম। রাত প্রায় দেড়টা দুটার সময় আমরা পশ্চিম পটিয়ার ৮নং কাশিয়াইশ ইউনিয়নের পিঙ্গলা বড়ুয়া পাড়ায় এসে আস্তানা গাড়লাম। পরদিন সন্ধ্যায় কমান্ডার নবী তার গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে তার নিবাস পটিয়ার হুলাইন গ্রামের দিকে চলে গেল। নবী গ্রুপ সেই যে গেল পরে জিরি ওহাবি মাদ্রাসা অপারেশনে কমান্ডার নবীকে অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সাথে সংযুক্ত করতে পারিনি।” গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন (ভারপ্রাপ্ত) আহমদ নবী। আসলে ওনি কি বলতে চাইছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বর্ণনায় সিরু বাঙালির বক্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের এপ্রিলে কালুরঘাটে হওয়া যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে সিরু বাঙালি তার ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইয়ের ১৬৮ ও ১৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “আমার কাছে রক্ষিত চারটি ৩৬-ই হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৭.৬২ মি.মি ২০০ রাউন্ড গুলি নিযে হামিদচরের ভেতর দিয়ে কর্ণফুলীর তীর বেয়ে গ্রামে পালিয়ে এলাম। কিন্তু ওই চারটি গ্রেনেড ও গুলি কার কাছ থেকে কীভাবে পেলেন তা বইয়ে উল্লেখ করেননি সিরু বাঙালি। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা ‘সদ্য বিদ্রোহ করে বসা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর যুদ্ধটি হয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে কালুরঘাট যুদ্ধে সিরু বাঙালির গ্রেনেড পাওয়া দূরে থাক, সেখানে তার যুক্ত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। কারণ যুদ্ধটি ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর মধ্যকার।’
জামাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘সিরু বাঙালি তার গ্রন্থের ৭৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “চট্টগ্রামে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে কিছুই নাই, চট্টগ্রামে কারো সাথে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। বিশেষ কাউকে আমি চিনতাম না।” চট্টগ্রাম সম্পর্কে যার কোন ধারনাই নাই; তিনি কিভাবে চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক কথিত অপারেশন করেছেন? এদিকে কালুরঘাট যুদ্ধ থেকে পাওয়া কথিত সেই চারটি গ্রেনেড দিয়ে তিনটি অপারেশন করার কথাও নিজের বই ও ফেসবুকে লিখেছেন সিরু বাঙালি। যদিও তার এসব কথার মধ্যে অনেক অসঙ্গতি আছে। কারণ মে মাসের ১ ও ৩ তারিখ তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটনানোর কথা সিরু বাঙালি লিখলেও ওই সময়ে তিনি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নেননি, যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।’
এমন কল্পকাহিনী লজ্জিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিরু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক-যে নামেই তিনি পরিচিত হোন না কেন তিনি যে মিথ্যাচার করছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি তাঁর মিথ্যাচারে তিনি লজ্জা না পেলেও আমরা লজ্জা পাই। এ লজ্জা কীভাবে ঢাকি? আমরা মনে করি সিরু বাঙালির মিথ্যাচারে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে। এর দায় অবশ্যই সিরু বাঙালিকে নিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফেরদাউছ ইসলাম খান, এ এইচ এম নাছির উদ্দিন চৌধুরী, মুহা. ইদ্রিচ আলী, দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ প্রমুখ।