অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশের নাগরিক ও সুশীল সমাজকে আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন পানি সম্পদ এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের যে দীর্ঘপথ, সেই রাস্তাটা মসৃণ হওয়ার বাস্তবিক কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। সেজন্য বলব– আমাদের ওপর একটু আস্থা রাখুন। এখনই অন্তর্বর্তী সরকার, সরকারের সফলতা নিয়ে উপসংহারে চলে আসার সময় হয়নি, কোনো কারণও ঘটেনি।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) ‘নাগরিক সমাজ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন। রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে এ সভার আয়োজন করা হয়।
দেশে কর্মরত তিন শতাধিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), নাগরিক সংগঠন ও প্ল্যাটফর্ম, নারী আন্দোলন, মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক উদ্যোক্তা এবং গবেষকদের ঐক্যজোট সিএসও অ্যালায়েন্স এ পরামর্শ সভার আয়োজন করে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা তথ্যের অবাধপ্রবাহ নিশ্চিত করছি। কেউ যখন কোনো আন্দোলন করছেন, দাবি তুলছেন; আমরা বলছি– আপনাদের মুখপাত্রকে পাঠান, আমরা বসব; বলব। আমাদের দরজা আলোচনার জন্য সবসময় খোলা। এটিই বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র গঠনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথাগত সরকারগুলোর পথে অন্তর্বর্তী সরকার হাঁটছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথাগত সরকারগুলো যেভাবে সমস্যা হ্যান্ডেল করেছে, আমরা সেভাবে সমাধানটা করতে চাচ্ছি না। ভিন্নধারায় সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছি। সেটা আপনারা দেখতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে আপনারা সহায়তাও করছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটা অন্তর্বর্তী সরকারের নয়, সরকারের উপদেষ্টাদেরও নয়; এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের ডিমান্ড (চাহিদা)। সেই কাজটা করতে আমরা সংলাপ–আলোচনা শুরু করেছি। কমিশন করেছি, নিজেরাও কাজ করছি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে খালি চোখে দেখতে নিরুৎসাহিত করেছেন রিজওয়ানা হাসান। তার ভাষ্য, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কতগুলো জায়গায় যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তার ভেতরে কিন্তু অন্য কিছু কাজ করছে। হঠাৎ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো। আমি নিজে এ বাংলাদেশে বড় হয়েছি। নিজের মধ্যে তো সাম্প্রদায়িকতা দেখিনি। কাজেই খালি চোখে যা দেখা যায়, ঘটনার অন্তরালে আরও অনেক ঘটনা থাকে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, কোনো ক্ষেত্রে যদি আপনারা দেখেন বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে আমরা এগোতে পারছি না; এটুকু মনে রাখবেন যে, বৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা এতটা সহজও হবে না। নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের পথ মসৃণ নয়। কারণ প্রত্যেকেই কিন্তু তার ফুটপ্রিন্ট রেখে গেছে এ দেশে। প্রত্যেকে কিন্তু সুবিধাবাদীদের রেখে গেছে। তারাও কিন্তু অ্যাক্টিভ ফোর্স হিসেবে মাঠে কাজ করছে। তবে, যদি কখনো দেখেন সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্য প্রতিষ্ঠার জায়গাগুলোতে আক্রমণ হয়েছে বা হচ্ছে, সেটা বলবেন। আবার সবসময় আক্রমণের একই ব্যাখ্যা বা সরলীকরণের সুযোগ আছে বলেও মনে করি না। সেজন্য আমাদের সংস্কারের পথটা এতটা মসৃণ হওয়ার সুযোগ নেই।
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা যদি হয়, সেখানেও এত রকম ইন্টারেস্টের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে হবে; গত ৫৩–৫৪ বছরে যে ধারা চলে আসছে, তার বিরুদ্ধে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি একদম পারফেক্ট সরকারও হন, তবুও অনেক রকম বাধার মুখোমুখি আপনাকে হতে হবে।
২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে দেশে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ফান্ড আটকে দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, নির্বাচনের আগে আমাদের অনেক এনজিওর ফান্ড আটকে দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য কর্মীদের পর্যন্ত বেতন দিতে পারিনি। নির্বাচনের পর সেই টাকাগুলো আস্তে আস্তে ছাড়া হলো। মুখ বন্ধ করতে অনৈতিক কাজ তখনকার সরকার করেছিল। এ কথাগুলো সামনে আসেনি। এগুলো সামনে আনা উচিত।
তিনি বলেন, টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা একটি সরকার, সেই সরকার নেতিবাচক একটি ধারা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। সেগুলো নিয়ে এখন কথা বলার যথেষ্ট উপযুক্ত সময়। গত কয়েক বছর নানা ধারনের ঘটনায় সিভিল সোসাইটিকে যেভাবে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন ছিল, সেভাবে কিন্তু করা সম্ভব হয়নি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা মানবাধিকার, পরিবেশের অধিকার নিয়ে কাজ করি। সরকার কোন নীতি করল, সেটার অসামঞ্জস্যতা কী, সেখানে সমস্যা কোথায়; সেটা নিয়ে কথা বলব। সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে, আমরা সেটার পরিবেশের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলব। এটাই আমাদের কাজ। অথচ আমাদেরকে এখানে কাজ করতে হয়েছে এমনভাবে যে, সরকারের নীতির সঙ্গে আমরা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবো। আমরা অনেকে দলীয় আনুগত্য বা নিজেদের একটি দলের লোক বলে দেখানোর চেষ্টাও করেছি। এতে এনজিওখাত অনেক বড় ইমেজ সংকটে পড়েছে। সেজন্য আগামীতে আমরা নিজেদের স্বকীয়তা ঠিক রাখব। বাধা এলে সামষ্টিকভাবে এগোব।
প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি করা হলেও এনজিও কমিউনিটি বা সুশীল সমাজ মুখ খোলেনি বলে মন্তব্য করেছেন রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, আমাদের যিনি বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তাকে যখন জেলে নেওয়া হচ্ছিল, আদালতে আদালতে ঘুরানো হচ্ছিল; আমরা জানতাম সেখানে প্রায় পুরোটাই তাকে হয়রানি করা হচ্ছে, অভিযোগগুলো প্রায় সবই মিথ্যা–ভিত্তিহীন। তখন এনজিওগুলোর অ্যালায়েন্স বা সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলতে পারতাম। কিন্তু সেটা পারিনি, মুখ খুলিনি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিশেষ করে গত ৬–৮ বছর আমরা যে চাপের মধ্যে ছিলাম, সেটা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। ফরেন ডোনেশন্স রেগুলেশন আইন করে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। লাইসেন্স বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার। ফলে মুখ খুলতে পারিনি। আমরা তার প্রতিবাদ দিয়েছি। তবে আইন মানতে বাধ্য হয়েছি। এই যে গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটা আইন করে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছিল। অনেক খাত সংস্কার নিয়ে এখন কথা হচ্ছে। এনজিও খাত সংস্কার নিয়ে কিন্তু কথা উঠছে না। যে এনজিও ব্যুরো এনজিও খাতগুলো নিয়ন্ত্রণ তদারকি করবে। সেই এনজিও ব্যুরো নিজে কতটা স্বচ্ছ? সেটাও বড় বিবেচনার বিষয়। এ খাতে আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলোর দিকে এখন নজর দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এনজিও প্রভাবিত বলে যে কথা উঠছে, তাতে সমস্যা দেখেন না রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে একটা কথা বলা হয়, এটা খুব বেশি এনজিও দিয়ে ঘেরা। আমি মনে করি, এখানে কোনো সমস্যা হবে না। এটা কোনো সমস্যাও নয়। যে সমস্যাগুলো আমাদের আইনে রয়ে গেছে, প্রশাসনে রয়ে গেছে; সেগুলোও যেন আমরা চিহ্নিত করি এবং সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপটা চালিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে পারি।
সিএসও অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সমাজকল্যাণ এবং নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শরমীন এস মুরশীদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিটির প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।