চট্টগ্রামে শারদীয় দুর্গোৎসবের মঞ্চে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেছে একদল তরুণ। অভিযোগ উঠেছে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির সদস্যরা এটি করেছেন। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজনে নগরের জেএম সেন হলের শারদীয় দুর্গোৎসবের মঞ্চে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরের আন্দরকিল্লা জেএমসেন হলের শারদীয় দুর্গোৎসবের মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সংগীত পরিবেশন করেন। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি নিউজপোর্টালের লাইভে দেখা যায়, সেখানে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির শিল্পীরা দেশাত্ববোধক গানের পাশাপাশি ইসলামী সংগীতও পরিবেশন করেছেন। তাদের শেষ পরিবেশনা ছিল ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। তাদের পরিবেশনা শেষে যারা সংগীত পরিবেশন করেছেন তাদের একজন মঞ্চে মাইক্রোফোন নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজিত এই সুন্দর আয়োজনে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ সকল সদস্যদের চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারক জানিয়ে আমরা বিদায় নিচ্ছি।’
এরপর পর পূজা উদযাপন পরিষদের ঘোষককে বলতে শোনা যায়, ‘অনেক অনেক শুভকামনা। ধন্যবাদ চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির শিল্পীবৃন্দদের। অসম্প্রদায়িক একটি বাংলাদেশ গড়ার যেই সঙ্গীত উনারা পরিবেশন করলেন সে জন্য বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ।’
তবে বিষয়টি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে থাকা অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তবে পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যারা ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেছেন তাদের আমরা চিনি না। সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক কেউই আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি। তখন আমি অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে ছিলাম। আমাদের পরিষদের একজন সদস্যকে দেশাত্ববোধক গান পরিবেশনের কথা বলে তারা মঞ্চে উঠে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে আমরা বৈঠক বসেছি।’
এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে মঞ্চে উঠে চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য্য বলেন ‘আমাদের পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সজল দত্ত ওই সংগঠনকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা দাওয়াতি গানটা করেছেন তাদের উদ্দেশে বলি, এটি সনাতন ধর্মের অনুষ্ঠান উনাদের বোঝা উচিত ছিল। উনারা যে দাওয়াতি গানটা গেয়েছেন সেটি আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ে আঘাত করেছে। তাৎক্ষণিক যুগ্ম সম্পাদককে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করি। কেন কোন অধিকারে আমাদের নির্দিষ্ট শিল্পী ছাড়া এই সংগঠনে মঞ্চে গান করবেন। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। তারা দেশাত্মবোধক গান করবে বলে জানিয়েছিল। গানটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার সেক্রেটারি ও অন্যান্য কর্মকর্তারা খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এদিকে সংগঠনটির ফেসবুক পেইজে লেখা আছে,চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি ‘একটি অরাজনৈতিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন। সুস্থ ধারার সংস্কৃতি বিকাশে বদ্ধ পরিকর।’
অন্যদিকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ছয়জন যুবক মঞ্চে ‘শুধু মুসলমানের লাগি আসেনিকো ইসলাম, বিশ্ব মানুষের কল্যাণে সষ্ট্রার এই বিধান’ শিরোনামে একটি ইসলামী সংগীত পরিবেশন করছেন। সংগীতটির গীতিকার চৌধুরী আবদুল হালিম। শেষ সংগীতটি পরিবেশনের সময় তাদের পাশে একজন নারীকেও দেখা গেছে। এ নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে থাকা অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের সভাপতি ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমরাও শুনেছি। চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি নামের কোন সংগঠনের সঙ্গে শিবিরের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের সংগঠনের কোন নেতাকর্মী সংগীত পরিবেশন দূরে থাক জেএমসেন হলেও যায়নি। বিষয়টি আমরা ফেসবুক লাইভে গিয়ে জানাবো।’
জামায়াতে ইসলামীর কেউ সেখানে গিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাওয়ারতো কথা নয়। আমাদেরতো সেখানে গিয়ে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করার প্রশ্নই উঠে না।’
জামায়াত ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরের প্রচার সম্পাদক মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এখন বাসায় আছি। জামায়াত ইসলামীর কেউ জেএমসেন হলে গিয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।’
পূজামণ্ডপে ইসলামি সংগীত পরিবেশনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। এ সময় তিনি বলেন, এ ঘটনায় যারাই জড়িত হোক না কেন, তাদের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে।
এর আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ) লিয়াকত আলী গণমাধ্যমকে বলেন,‘যারা ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন তারাও পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে এসেছিলেন। পূজা উদযাপন পরিষদের অনুমতি নিয়ে তারা সেখানে সংগীত পরিবেশন করেছেন। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু এখানে কোন সমস্যা নেই। তবুও আমরা এ বিষয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করছি। তারা অভিযোগ দিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যদিও ঘটনার আগে জেএম সেন হল পূজামন্ডপসহ বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ । তিনি নগরীর পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা এবং পূজা উদ্যাপনের বিষয়ে পূজা উদ্যাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন ও বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন। এসময় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আশ্বস্ত করেন, শারদীয় দুর্গোৎসব পালনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভক্তগণ যাতে উৎসবের সহিত নির্বিঘ্নে পূজা পালন করতে পারেন সেই ব্যাপারে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।