সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখন যে মামলাগুলো হচ্ছে সেই মামলাগুলোয় কোনো পদক্ষেপ না নিতে এবং কাউকে গ্রেপ্তার না করতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে কয়েকটি মামলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি করার অভিযোগেও মামলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরাতো বলেছি যে নিবর্তনমূলক যে আইনগুলো আছে, যেগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেবে, সেগুলো আমরা বাতিল অথবা সংশোধন করব। এই আইনগুলো সেই প্রক্রিয়াধীন আছে, পর্যালোচনায় আছে। যে মামলাগুলো হচ্ছে আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে বলেছি সেই মামলাগুলোয় যাতে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করা না হয়। যেহেতু আইনটি পর্যালোচনার মধ্যে আছে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যারা মামলা করেছেন তাদের আমরা চিনি না। আমরা নিরুৎসাহিত করছি। একটি মামলা তো ধর্ম অবমাননার কথা বলে করা হয়েছে। আমাদের নামগুলো সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই মামলাগুলো আমাদের বিব্রত করতে করা হচ্ছে কি-না এটাও আসলে আমাদের একটু দেখতে হবে।”
২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে পটুয়াখালীর আদালতে মো. মাসুম বিল্লাহ (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছেন হাসান মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি। ওই জেলার কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আশিষ রায় বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছেন।
দণ্ডবিধির ৩০৭/৪৯৯/৫০৬ (৪) মামলাটি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মো. মাসুম বিল্লাহ রেলওয়ের কমলাপুর স্টেশনের একজন পয়েন্টসম্যান। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সময়নিউজ ডট টিভি এবং ঢাকা নিউজের শেয়ার করা ভিডিও দেখে মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, “আপনাকে দেখে মনে হয় আমেরিকার দালাল।”
এমন মন্তব্যে মামলার বাদী হাসান মাহমুদ ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, মাসুম বিল্লাহ এলাকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে “সুদখোর, ইহুদি, পশ্চিমা দালাল” বলে মানহানিমূলক উক্তি করেছেন। মাসুম বিল্লাহ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে “একা পেলে গুলি করে হত্যা করার” হুমকিও দিয়েছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পুলিশ ওই মামলার আসামিকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করেনি।
এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার হারিয়াছড়ি গ্রামের মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। মামলা করেন একই গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগও আনা হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বিচারক জহিরুল হকের আদালতে মামলা করা হয়।
মামলার আবেদন গ্রহণ করে আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) আগামী ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি বিষয় ছিল বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার পথে বাধা নিবর্তনমূলক আইনগুলো বাতিল করা। কিন্তু এখনও সেই সাইবার আইনে মামলা হওয়া দুঃখজনক। এই আইনে কথা বলার জন্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেও এই আইনে মামলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা সেই জায়গা থেকে দ্রুত এই আইনটি বাতিল করা দরকার।”
আর নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, “এই আইনটি পুরোপুরি একটি নিবর্তনমূলক আইন। বিগত সরকার তার অপকর্ম, দুর্নীতি অব্যাহত রাখতে এই আইনটি ব্যবহার করেছে। এই আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এই আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদকে তো রিমান্ডে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও এই আইন থাকে কীভাবে?”
তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার এসেছে। তাই তাদের জনপ্রত্যাশা পূরণ করে এই আইন বাতিল করতে হবে। এই আইনে মামলা বা গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “শেখ হাসিনার নিবর্তনমূলক আইনে এখনও কীভাবে মামলা হয়! প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাকে কটূক্তি করলে তারা দেখবেন। তাতে অন্যের কী? যারা মামলা করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই এখন মামলা করা উচিত। এই আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এর অপব্যবহার এখনই বন্ধ করতে হবে। আর এই আইনে এখন পর্যন্ত দায়ের করা সব মামলা বাতিল করতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “সাইবার অপরাধ দমনে আইনের দরকার আছে। কিন্তু এই হয়রানিমূলক আইন চলতে পারে না। আমরা শুরু থেকেই তাই এর বিরোধিতা করেছি। এখনও এই আইনের অপব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। আইনটি পরিবর্তন বা বাতিলের আগে সরকার চাইলে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে এই আইনে মামলা নেওয়া বা এর অপব্যবহার বন্ধ করতে পারে।”