বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অন্তত ১৯ ধরনের সেবামূলক কাজ করে। ১৯৮৭ সালে সংস্থাটির গঠনের পর থেকে সেবা দিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে জনবল সংকট ও জবাবদিহির ঘাটতির পাশাপাশি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নিয়োজিত ভেন্ডরদের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ। বিআরটিএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এসব সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ছেন কর্মকর্তারা। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো কাজ না করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এর ফলে ড্রাইভিং লাইসেন্স, যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস কিংবা নবায়ন সব ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। এর জেরে বদনাম ঘোচাতে পারছে না বিআরটিএ।
অভিযোগ আছে, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর ভেন্ডর হিসেবে নিয়োজিত কিছু অপারেটর হয়ে ওঠে বেপরোয়া। বদলির ভয়ে অনেক কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন সহযোগী। সেবা দিতে ব্যর্থ হলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত কম। চিঠি দিয়ে সতর্ক করা কিংবা অনুরোধ করেই দায়িত্ব সারছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, যানবাহনের ফিটনেসের অনিয়ম এড়াতে চালু করা হয়েছে আধুনিক ভেহিকল ইন্সপেক্টর সেন্টার (ভিআইসি)। এ জন্য সিএনএস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বিআরটিএ। তা ছাড়া ডাটা আর্কাইভিংয়ের কাজও করেছে একই প্রতিষ্ঠান। এ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন অনিয়মে; দালালির কাজে। এদের একজন আব্দুর রশিদ। দিনে ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন তিনি। বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে দেওয়ার নামে তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন এমন প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদকের একটি টিম অভিযান চালিয়ে তাকে হাতেনাতে আটক করে। এ প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মী ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে দালালিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ধরা পড়ে দুদক টিমের সরেজমিন পরিদর্শনকালে।
সিএনএস নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আরেক প্রতিষ্ঠান টপ আইআই কোম্পানির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ মিলেছে। এর জের ধরে রাজধানীর কাফরুল থানায় সিএনএসের তিন কর্মকর্তার নামে জিডি করার ঘটনা ঘটে। সেখানে বলা হয়েছেÑ সিএনএস লিমিটেডের সঙ্গে টপ আইআই ডিজিটালাইজ পদ্ধতিতে ফিটনেস কার্যক্রমের পরিচালনা ও মনিটরিংয়ের চুক্তি রয়েছে। যৌথ বিনিয়োগে পরিচালিত হলেও টপ আইআইকে কোনো হিসাব দিচ্ছে না সিএনএস। বিআরটিএ অফিসে এ নিয়ে হিসাব চাইলে অভিযুক্তরা হুমকি দেন বলে জিডিতে দাবি করেছেন টপ আইআই কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার এম রাকিবুল হাসান। তিনি জানান, সিএনএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই চিন্ময় মণ্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জিডির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে উভয়পক্ষকে (বাদী-বিবাদী) নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু অভিযোগের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সুরাহা হয়নি। তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’
জানা গেছে, যানবাহনের নিবন্ধন ও মালিকানা বদলিকালে সংগ্রহ করতে হয় ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ডিআরসি)। কিন্তু কার্ড সংকটের কারণে ডিআরসি পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বারবার ডেলিভারির নতুন তারিখ দেওয়া হচ্ছে। একই অবস্থা ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও। ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের সঙ্গে বিআরটিএর সঙ্গে চুক্তির পর থেকেই লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড সংকটের খবর আসছে। আবার এ প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী গ্রাহককে হয়রানি করেন এমন অভিযোগও আছে। মোহাম্মদ ইসমাইল নামের পেশাদার চালক এ রকম হয়রানির শিকার হয়েছিলেন মিরপুর-১২ নম্বরে প্রতিষ্ঠানটির দপ্তরে। তার রেফারেন্স নম্বর ১৪২৫…। সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে ভালো খবর হচ্ছে এখন ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে বিআরটিএ; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গ্রাহকের কাছ থেকে কার্ডের টাকা নেওয়ার পর এখনো কার্ড সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগ থেকে বের হতে পারছে না সংস্থাটি। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় প্রসঙ্গটি আসে। বৈঠকের সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গটি তুললে বিআরটিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখনো সাড়ে চার লাখ কার্ড সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। এ সময় সাবেক নৌমন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান দাবি করেন সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। এ নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের বিষয়ে একমত পোষণ করেন বৈঠকে উপস্থিত অতিথিরা। চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স কার্ড ও ডিআরসি কার্ড সরবরাহ করতে না পারার বিষয়টি গুরুত্ব পায় ওই সভায়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সেবার মান বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রথা চালু হয়েছে। তা ছাড়া গ্রাহকের একবার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পর আর বিআরটিএ অফিসে কাজ নেই। ডাকযোগে বাসায় লাইসেন্স পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের (ডিআরসি) ক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থাপনা আসছে। ছবিসহ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার পর ই-সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন। কার্ডের দরকার নেই। ফিটনেসের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা এসেছে। মিরপুরের পর অন্যান্য স্থানেও ভিআইসি (ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার) চালু হচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী সেবা না দেওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহনের সচিব বলেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চুক্তি বাতিল একমাত্র সমাধান নয়। মনে রাখতে হবে, এতে যেন গ্রাহক ভোগান্তি না বাড়ে। মামলা করে প্রক্রিয়াটি যেন ঝুলিয়ে দেওয়া না হয়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই সমাধানে জোর দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্সের জন্য নতুন করে টেন্ডার হচ্ছে। এ রকম সব ক্ষেত্রে বাস্তবতা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মোট কথা, মানুষের সেবা নিশ্চিত করা এবং দুর্ভোগ লাঘবে আমাদের নজর।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটিতে ৭২ লাখ ৬০ হাজার ৭৭২টি লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে অপেশাদার ৫৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৮টি এবং পেশাদার লাইসেন্স আছে ১৯ লাখ ২১ হাজার ৩৯৪টি। এ তালিকায় একজন একাধিক শ্রেণির কার্ডের গ্রাহক। এর বিপরীতে সারা দেশে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫টি. যদিও অনেক গাড়ির বর্তমানে অস্তিত্বও নেই। এর মধ্যে বর্তমানে ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৮টি ফিটনেসখেলাপি। বাস্তবে অস্তিত্ব আছে এমন ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা নেই বিআরটিএর কাছে। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানানো হয়, এ জন্য কাজ চলছে। তবে ভেন্ডরের কারণে সরকার তথা বিআরটিএর ভাবমূর্তি যেন ক্ষুণ্ন্ন না হয়, সেদিকে নজর দিতে জোর দিয়েছেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা।