সেন্টমার্টিন (নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ) নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বিদেশি পরামর্শে চলছেন কিন্তু দেশের মানুষের পরামর্শ ও দাবি-দাওয়াকে পাত্তা দিচ্ছেন না। বিদেশি জার্নালের পরামর্শে তিনি নিজ দেশের পর্যটন শিল্প ও দ্বীপবাসীকে একটা মারাত্বক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। যেটা কোনো দেশপ্রেমিকের কাজ হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’। তাদের দাবি নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে যাতায়াত ও অবস্থানে সরকারি বাধা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) দুপুর ১২টায় রাজধানীর ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র সদস্যরা এমন মন্তব্য করেন। তারা পরিবেশ উপদেষ্টাকে বাস্তবসম্মত এবং দেশ ও জনগণের পক্ষ হয়ে কথা বলার আহ্বান জানান।
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির আহ্বায়ক ঢাবি শিক্ষার্থী মুহম্মদ জিয়াউল হকের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাবি শিক্ষার্থী মুহম্মদ মুহিউদ্দীন রাহাত, যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাবি শিক্ষার্থী ইয়াকুব মজুমদার, সদস্য ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের শিক্ষার্থী সংগীতা শারমিন, সদস্য ঢাবি শিক্ষার্থী রাফসান, সাইদুল প্রমুখ।
মুহম্মদ জিয়াউল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিদেশি জার্নালের রেফারেন্স টেনে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছেন, পর্যটকরা কোরাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তাই ২০৪৫ সালের মধ্যে নাকি সকল কোরাল ক্ষয় হয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ (নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ) ডুবে যাবে! পরিবেশ উপদেষ্টার এই কথা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। উপদেষ্টা কখনো দ্বীপে গিয়েছেন কিনা, অথবা গিয়ে কখনো এসবের সত্যতা জানার চেষ্টা করেছেন কিনা- আমরা তা জানি না। তবে গিয়ে থাকলে এমন অবাস্তব কথা তিনি বলতে পারতেন না।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে – দ্বীপের কোরালগুলো অনেক বড়, অনেক ওজন, অনেক ধারালো এবং পানির অনেক নিচে থাকে যেগুলো মানুষের পক্ষে তুলে আনা সম্ভব নয়। কোরাল নিয়ে আসা দূরের কথা, জীবন্ত কোরালে হাত দিলেই হাত কেটে যায়। তাই কথিত বিদেশি জার্নাল কিংবা পরিবেশবাদীদের কোরাল নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে বক্তব্য সেটি অসত্য ও মিথ্যা প্রচারণা। মূলত প্রাকৃতিক কারণেই কিছু কোরাল মারা যায়। আবার নতুন কোরাল জন্মায়। পর্যটকদের কেউ কেউ সাগরে ভেসে ওঠা সেই মৃত কোরাল অনেক সময় নিয়ে আসেন যেটাতে দ্বীপ কিংবা পরিবেশের ক্ষতি নয় বরং উপকার হয়, সাগর পরিচ্ছন্ন থাকে। তারপরেও সেসব মৃত কোরাল আনার ব্যাপারে যদি নিষেধাজ্ঞা থাকে সেটা সরকারিভাবে বাস্তবায়ন করলেই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে দ্বীপে যাওয়া ও অবস্থানের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার রহস্য জনগণ জানতে চায়।
আরও বাস্তবতা হচ্ছে- নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ শুধু কোরাল দিয়েই তৈরি নয়, শক্ত পাথর দিয়েও তৈরি। কোরাল নয়, শক্ত পাথরই এর মূল ভিত্তি। তাই কোরাল যদি তুলেও নেয়া হয়, তবুও পাথরের ভিত্তির উপর দ্বীপ টিকে থাকবে। কাজেই ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপ হারিয়ে যাবে’ বিদেশি জার্নালের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, কল্পনাপ্রসূত এবং এটাকে কন্সপিরেসি থিউরি (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) বললে অত্যুক্তি হবে না।
জিয়াউল হক আরও বলেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণেই নারিকেল দ্বীপ ২০৪৫ সালের মধ্যে তলিয়ে যাবে মর্মে বিদেশি জার্নালের যেই বক্তব্য প্রচার হচ্ছে সেটিরও বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কথিত ওই গবেষণাটি পরিবেশবাদীদেরকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করতে হবে। সেখানে গবেষক টিমে কারা ছিল, তারা কোন মতবাদে বিশ্বাসী, তাদের গবেষণাটি কতটুকু সঠিক কিংবা বায়াসড ছিল, তাদের ফান্ডিং করেছে কোন সংস্থা, তাদের উদ্দেশ্য কী, রিসার্চের মেথডোলজি কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত ছিল, মাঠ পর্যায়ে কয়দিন গিয়েছে, কী কী বিষয়ের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, কার কার বক্তব্য নিয়েছে, যাদের বক্তব্য নিয়েছে তারা কারা অর্থাৎ কথিত বিদেশি জার্নালের গবেষণার সম্পূর্ণ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে- এসব কিছুই খতিয়ে না দেখে দু’একটি বিদেশি জার্নালের রেফারেন্সে দেশিয় শিল্প বন্ধ করে দেওয়া হলো, আয়-রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়ে দ্বীপবাসীদের চরম মৌলিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলো।
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ইয়াকুব মজুমদার বলেন, বাস্তবে নারিকেল দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুর। দ্বীপে কুকুরের মাত্রাতিরিক্ত আধিক্য জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস ডেকে আনছে। ক্ষুধার্ত কুকুরের পাল সৈকতে আসা লাল কাকড়াকে আক্রমণ করে, কচ্ছপের ডিম খেয়ে ফেলে। দ্বীপে আনুমানিক ৫ থেকে ৬ হাজার বেওয়ারিশ কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দ্বীপ থেকে সেই কুকুর অপসারণ করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ পরিবেশ উপদেষ্টা এখন পযন্ত নেননি। তার সিদ্ধান্ত বরং পরিবেশকে যারা রক্ষা করেন সেই মানুষ অর্থাৎ দ্বীপবাসীকে বাস্তুচ্যূত করবে। এছাড়া উপদেষ্টা থাইল্যান্ডসহ বিদেশি পর্যটন স্পটের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশের নারিকেল দ্বীপে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেছেন। উপদেষ্টাকে আমরা বলবে- আমাদের নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ ভ্রমণ মাত্র চার মাসের জন্য হয়ে থাকে, বাকী আট মাস বন্ধ থাকে। কিন্তু অন্যান্য দেশের দ্বীপগুলো দুই তিন মাস বন্ধ থাকে। বাকী সময়গুলো খোলা থাকে। সেটি কেন বললেন না?
ইয়াকুব আরও বলেন, আমাদের দ্বীপটি ভৌগলিক অবস্থানগতভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি অবস্থানে রয়েছে। দ্বীপে ভ্রমণ বন্ধ রাখলে এক সময় দ্বীপ জনশূণ্য হয়ে যাবে। পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের মগ, আরাকানী ও ভারতের জেলেরা একসময় দ্বীপটি দখলে নেয়ার চেষ্টা চালাবে। ইতিমধ্যেই মিয়ানমার ও আরাকান আর্মি দ্বীপটিকে একাধিকবার তাদের বলে দাবিও করেছে। অর্থাৎ দেশের অখণ্ডতা রক্ষার তাগিদেই নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপকে সবসময় জনবান্ধব ও জনগণের আসা যাওয়াকে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবেশবাদসহ কোনো কিছু্র অজুহাতেই দ্বীপ ভ্রমণে বাধা দিলে দ্বীপটি আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপ ভ্রমণে সব ধরণের সরকারি বাধা তুলে নিতে হবে।
সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। এসময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।