চট্টগ্রাম নগরের অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতে ইমারত নির্মাণ আইনের তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে একের পর এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিদ্যালয়, ল্যাব, হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এ নিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ৩ এর ক ধারায় উল্লেখ আছে, আবাসিক বাড়ির জন্য ইমারত নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে আবাসিক কাজেই ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো কাজে, যেমন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
গত ২০১৫ সালের ৮ জুনের মন্ত্রিসভার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না। অথচ সে আইনের কোনরকম তোয়াক্কা না করেই পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক, হসপিটাল, অর্ধশত ডায়গনস্টিক সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যাংক, স্কুল, মুদিমনিহারি দোকান, লন্ড্রি, সেলুন, রেস্তোরাঁ, এটিএম বুথসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
বানিজ্যিকরনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর শত অভিযোগ থাকলেও এইসব বানিজ্যকরনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেনা গণপূর্ত, সিডিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এরই মধ্যে পাঁচলাইশ আবাসিকের জাতিসংঘ সবুজ উদ্যানে গণর্পূর্তের দোকান নির্মান করে বরাদ্ধ দেয়া নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ মাত্রা আরো বেড়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া ভাড়া চুক্তিপত্র প্রত্যাহার করে এই আবাসিকের মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রনালয় কতৃক জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান নির্মান করেন। এই উদ্যান নির্মানে এলাকার মানুষ কিছুটা হলেও উচ্ছসিত হয়েছে। কিন্তু আবাসিকের এই উদ্যানে গণপুর্ত মন্ত্রনালয়ের দোকান বরাদ্ধ দেয়ার খবরে এলাকাবাসির মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাধতে শুরু করেছে কারণ এটি বানিজ্যিকরনের সামিল।
এ নিয়ে জাতিসংঘ সবুজ উদ্যানে দোকান বরাদ্দ না দেয়া প্রসঙ্গে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যান সমিতির পক্ষ থেকে গনপূর্ত কতৃপক্ষের বরাবর গত ২৭শে অক্টোবর২০২৪ ইং তারিখে একটি দরখাস্ত দেন। এতে তারা দাবি করেন যে, এর আগে এই আবাসিকে বানিজ্যকরণ বন্ধে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। গণপূর্ত বলেছিল দোকান করা প্রসঙ্গেঁ গণপূর্ত এলাকার জনগণকে নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু কোনরুপ আলোচনা না করে দোকান নির্মান ও বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। যা এলাকার জনগণ কখনো মেনে নিবেনা।
এ বিষয়ে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যান সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সেলিম বলেন, সিটি কর্পোরেশন যখন এই পার্কটিতে বানিজ্যকরন করতে চেয়েছিল আমরা সেই বানিজ্যিকরনের বিরুদ্ধে রীট করেছিলাম। সেই রীটের মাধ্যমে বানিজ্যকরণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গণপূর্ত পরে সিটি কর্পোরেশনের ভাড়া চুক্তিপত্র বাতিল করে দিয়ে তারা আবাসিকের বাসিন্দাদের দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তবিনোদণের জন্য নতুন করে জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান নির্মান করে। এতে এলাকাবাসী অনেক খুশি হন। গণপূর্ত কতৃপক্ষ এলাকাবাসীর সাথে কোন পরামর্শ না করে এই পার্কটিতে একটি দোকান নির্মান করে বরাদ্ধ দেন। আবাসিক পার্কে দোকান নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অসোন্তষ বিরাজ করছে। কারন এতে বানিজ্যিকরনকে উৎসাহিত করা হয় এবং আবাসিকের পরিবেশ নষ্ট করবে। আর সেই সাথে আবাসিকের পার্ক যদি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে তাতেও আবাসিকের নিরাপত্তা ও পরিবেশ নষ্ট হবে। আমি এই এলাকার জনগণের পক্ষে পার্কে দোকান বরাদ্দের বিরুদ্ধে গণপূর্ত কতৃপক্ষকে দরখাস্ত দিয়েছি। আশা করি তারা শান্তিপূর্ন ব্যবস্থা নিবে।
গণর্পূর্ত-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম খান বলেন, পার্কে একটি দোকান বরাদ্ধ দেয়া হচ্ছে। এতে দর্শনার্থীদের পানিসহ সাময়িক কেনাকাটার জন্য। এতে পার্কের পরিবেশ কেন নষ্ট হবে বুঝতে পারছিনা। তবু আবাসিক এলাকার পার্ক হিসাবে বিষয়টি আমি মন্ত্রনালয়কে জানাবো। এবং আবাসিক পার্কে বাহির এলাকার দর্শনার্থী প্রবেশ বিষয়েও আমরা ভাবছি। আশাকরি খুব শীঘ্রই এসব বিষয়গুলো সমাধান করেই পার্ক চালূ করবো।
যদিও আবাসিক এলাকা বানিজ্যকরনের বিষয়ে এর আগে তিনি বলেছিলেন, গণপূর্তের ভুমিতে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আবাসিক হিসাবেই অনুমোদন রয়েছে। এখানে বানিজ্যকরনের কোন সুযোগ নাই। এরপরও এলাকার কতিপয় বাড়িওয়ালা আবাসিকের আইন ভঙ্গ করে এসব বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিচ্ছেন। তাদেরকে আমরা নোটিশ ও করেছি। আবাসিক এলাকায় এই বানিজ্যকরণ রোধে আমরা সার্বিক ব্যবস্থা নিবো।
পাঁচলাইশ আবাসিক কল্যান সমিতির নির্বাহীকমিটির সদস্য মোহাম্মদ নজরুল আজাদ বলেন, এই এলাকার অধিকাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত এই আবাসিক এলাকায় বসবাস করছি। নিরাপত্তাসহ নানাবিধ হয়রানির শিকার হচ্ছে আমাদের আবাসিকের বাসিন্দাদের। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে বানিজ্যকরনের বিরুদ্ধে ব্যানার টাঙ্গিয়েছি। তবু বন্ধ হচ্ছেনা বানিজ্যিকরন। আমরা সিডিএ, সিটি কর্পোরেশনকে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু কোন ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছেনা। এছাড়া পার্কে দোকান বরাদ্ধ দেয়া নিয়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি।
উল্লেখ্য যে, ২০১৩-২০১৫ সালের শেষের দিকে নগরীর পাঁচলাইশ, কাতালগঞ্জসহ কয়েকটি আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গুদাম ও হাসপাতালের যন্ত্র থেকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। একাধিক নোটিশ পেয়েও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে না নেয়ায় ২০১৫ সালের শেষের দিকে কয়েকটি আবাসিক এলাকায় অভিযানও চালায় সিডিএ। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে ২০১৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো অভিযান চালায়নি সিডিএ। এটা ঠিক যে, আবাসিক এলাকায় কিছু বাণিজ্যিক চাহিদাও থাকে। এজন্য পরিকল্পনার সময় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জোন আলাদা করা হয়, যাতে অন্য কোনো কিছু আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করে।