রেল যাত্রায় কক্সবাজার সিরাজুল করিম মানিক

বিজয় দিবস আনন্দ সম্মিলনে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এর তিনশত পরিবারের সাত শতাধিক সদস্যদের নিয়ে রেলওয়ে কক্সবাজার এক্সপ্রেসটি দু’দিনের এক আনন্দ ভ্রমণ শেষে নিরাপদে নগরে ফিরে আসল ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। কক্সবাজার এক্সপ্রেসটি ১৬ ডিসেম্বর সাত সকালে সৈকত নগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আনন্দ ভ্রমণে ক্লাব সদস্যদের উল্লাস ছিল সীমাহীন। বিশেষ করে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের বাধভাঙ্গা উল্লাস ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য।
কক্সবাজার এক্সপ্রেসটির ছিল পনের বগি। পুরো ট্রেনটি ছিল আনন্দ ভ্রমণ যাত্রীদের ভরপুর। এক্সপ্রেসের শেষ থেকে শুরু ছিল মাঝখানে করিডোর। যাত্রীদের আনগোনায় ছিল মুখরিত। শিশু, কিশোর-কিশোরীও কম যায়নি। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনটি ছিল সাত সকালে মিডিয়া পরিবার বর্গের পদচারণায় মুখরিত। এক্সপ্রেসের বগি ছিল বর্ণমালায় সজ্জিত। পরিবারগুলোর আসন ছিল পূর্ব নির্ধারিত। পরিচালক যথাসময়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য হাতল ঘুরায়। ট্রেনের চাকা ক্রমশ গতি পায়। বগির ভেতরে আনন্দ যাত্রীদের উল্লাস ইথারে ইথারে ভেসে উঠে।
ক্লাব কর্তৃপক্ষ সদস্য পরিবারের মধ্যে প্রাতঃরাশ বন্টন করে। প্রথম পর্যায়ে সেন্ডুইস ও ঝালনাস্তা। দ্বিতীয় পর্বে ফুডস ও সফট ডিংক। তৃতীয় পর্বে গিফট সামগ্রী। এদিকে এক্সপ্রেসটিও বেশ গতি লাভ করে। এর মধ্যে ঝাউতলা, আমবাগান, ষোলশহর অতিক্রম। এক্সপ্রেসটি এখন কালুরঘাট রেল ব্রিজ এর ওপর। উল্লেখ ১৯২৮ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকার রণকৌশল হিসেবে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেল ব্রীজ নির্মাণ করে। এ ব্রীজ এর বর্তমান বয়স ৯৫ বছর ছুই ছুই। ইতোমধ্যে এ ব্রীজ একাধিকবার সংস্কার হয়। অতি সম্প্রতি দোহাজারী-ঘুনধুম রেলপথ নির্মাণ এর প্রেক্ষাপট ব্রীজটি ব্যাপকভাবে সংস্কার করে নিরাপদ রেল চলাচলের উপযোগী করা হয়।
কর্ণফুলী নদী বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম এর লাইফলাইন। এ সময় নদীতে ভাটার টান। নদী সংলগ্ন ফেরী পারাবার। ফেরী ছিল বাস, ট্রাকসহ ছোট ছোট যান বাহনে টাসা। এ ফেরীই চট্টগ্রাম বোয়ালখালীর সংযোগ সড়ক। কর্ণফুলী রেল সেতুকে বোয়ালখালীবাসীর দুঃখ হিসেবে পরিচিত। বাণিজ্য নগরীর এক-দেড় কিলোমিটার দূরের বোয়ালখালী যেন বহু দূরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বোয়ালখালীর ৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণের দাবী কর্ণফূলী নদীতে রেল-সড়ক সেতু। কত প্রাণ গেল, কত সংগ্রাম হল। কত সরকার গেল আর আসল। কিন্তু কর্ণফুলীতে সেতু হলনা।
এক্সপ্রেসটি কর্ণফুলী ব্রীজ পারাপার কালে মিডিয়া কর্মীদের ক্লিক ছিল চোখে পড়ার মতো। এক্সপ্রেসটি ক্রমশ: গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছিল। বোয়ালখালীর গোমদন্ডী, ফুলতলী, পটিয়া, কাঞ্চননগর হয়ে এখন দোহাজারী পুরাতন রেল ষ্টেশন। ষ্টেশনটি বৃটিশ আমলের হলেও হালে সংস্কারের হাত পেয়ে ঝকঝক করছে। কিছুটা সংস্কারও হল। তবে মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয়নি।
এক্সপ্রেসটি মিডিয়াম গতিতে ক্রমশ: সামনের দিকে এগুছে। দু’পাশের মানুষ ছিল সাত সকালের আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠা। কেউ কেউ ষ্টেশনে দোকান পাট খুলছে। কেউ কেউ পাশের বিলে চাষাবাদের কাজ শুরু করছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটছে।
দোহাজারীর শংখ নদীতে সদ্য নির্মিত ব্রীজটি আলো ছড়াচ্ছিল। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এটি উদ্বোধন করা হয়। দোহাজারী পৌর এলাকা সংলগ্ন শংখ নদীর ওপর পুরাতন দোহাজারী সড়ক ব্রীজ। ব্রীজটিও বেশ পুরাতন। এখন তা বাধ্যকে উপনীত। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সড়কের প্রথম পর্যায়ে শংখ নদীর ওপর দোহাজরী ব্রীজের পাশাপাশি একটি নতুন রেল সেতু নির্মাণ করে। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩ শত কোটি টাকা। বর্ষাকালে শংখ নদীর কি প্রবল প্রতাপ। দু’কূল ছাপিয়ে তা গ্রামগঞ্জ ভাসিয়ে দেয়। এ সময় তা শুকনা নদী। নদীতে চর ওঠেছে। যেন একটি মরা নদী।
নবনির্মিত দোহাজারী কক্সবাজার রেল সড়ক। সাতকানিয়া লোহাগাড়ার দু’পাশেই বসতবাড়ি, মসজিদ, দোকানপাট দীঘি-পুকুর শোভা পাচ্ছে। শতশত বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে রেল সড়ক নির্মিত হয়েছে। দোহাজারী কক্সবাজার রেল সড়কটির দৈর্ঘ্য ১০১ কিলোমিটার। নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৬ হাজার টাকা। সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন ব্যয় নির্ধারিত ছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বাকী টাকায় রামু-ঘুনঘুম ২৯ কিলোমিটার রেল সড়ক নির্মিত হবে পরবর্তীতে।
কক্সবাজার পর্যটন নগরীতে রেল আসবে এ গল্পটি এলাকাবাসী শুনেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সবশেষ গত বছরের নভেম্বর সরকারী রেল পরিদর্শকের বিশেষায়িত ট্রেন যখন প্রথমবারের মতো দোহাজারী ষ্টেশন পেরিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছিল তখন দোহাজারী হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল সড়কের দু’পার্শ্বে লাখ লাখ মানুষ রেলকে অভ্যর্থনা জানায়। দোহাজারী হতে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার জুড়ে ট্রেনটি ধীর গতিতে ৯ ঘন্টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার পৌঁছে। ৯২ বৎসর ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল এলাকাবাসী। তখন দু’পাশের মানুষ বিলের ধারে, পাহাড়ের চুড়ায়, উঠান কিংবা ঘরের দরজা, জানালায় উঁকি দিয়ে ট্রেনটি প্রথমবারের মতো দেখেছে স্থানীয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সড়কে লট-১ এ ৫৫টি লেভেল ক্রসিং এর মধ্যে ২৮টি আন্ডারপাস, লট-৩ এ ৬০টি লেভেল ক্রসিং, ৪২টি আন্ডার পাস। কক্সবাজার এলাকায় আন্ডার পাস বেশী। আন্ডার পাসগুলো স্থানীয়দের চলাচলা সুবিধা দেয়। সবচেয়ে বেশী আন্ডারপাশ হলো রামু এলাকায়। এ আন্ডারপাসগুলো বন্যা ও বর্ষাকালীন পানি চলাচলের সুবিধা দেবে।
কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হচ্ছে চুনতী, ফাসিয়াখালী বন্য প্রাণী অভ্যয়ারন্য এবং মেধাকচ্ছাপিয়া ন্যাশনাল পার্ক। চুনতিতে ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার, ফাসিয়াখালী ১০ কিলোমিটার ৩ দশমিক ও মেধাকচ্ছাপিয়া ন্যাশনাল পার্কে প্রায় ১ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। চুনতীতে বন্য হাতি পারাপারে ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ ধরনের ওভারপাস। যা এশিয়া অঞ্চলে প্রথম। পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাতি পার হবে রেল লাইনের ওপর দিয়ে এজন্য রেল লাইনের ওপর কৃত্রিম পাহাড় ও বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হয়। সেখানো লাগানো হয়েছে ৪১ প্রজাতির গাছপালা। হাতির জন্য লবন পানির জলধার ও রেলপথে না উঠতে সীমানা প্রাচীরসহ লাগানো হয়েছে বেত গাছ। হাতির খাবারের জন্য লাগানো হয়েছে লক্ষাধিক বিভিন্ন জাতের গাছ। এছাড়া হাতি পারাপারের জন্য নির্মিত হয়েছে ৩টি আন্ডারপাস। রেল চলাচলে ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হয়েছে সেন্সরযুক্ত ডিভাইস। ফলে হাতি বা বন্যপ্রাণী রেল লাইনে উঠে গেলে সর্বোচ্চ ১ কিলোমিটার দূর থেকে রেল চালক তা বুঝতে পারবে।
এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছিল কক্সবাজার অভিমুখী। পথিমধ্যে বিভিন্ন ষ্টেশন ধীর গতির ফলে রেলযাত্রী তথা আনন্দে সম্মিলন যাত্রীদের ষ্টেশন অবলোকন হয়। দর্শক-যাত্রীর মধ্যে ভাব শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। যতই কক্সবাজারের দিকে ট্রেন ছুটছিল ততই কক্সবাজারগামী মিডিয়া পরিবারে উত্তেজনা উৎসাহ ও আনন্দবোধ বাড়ছিল।
এক্সপ্রেসটি এখন চকরিয়া পৌরসভা সংলগ্ন খরস্রোতা নদী মাতামুহুরীর ওপর। মাতামুহুরী নদীর ওপর নতুন রেল সেতু নির্মিত হয়েছে। নতুন রেলসেতুটি বেশ নান্দনিক। ঝকঝক করছে। চারদিকে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। এটি পুরাতন চকরিয়া সেতুর পাশে। নতুন রেল সেতুটি খরস্রোতা মাতামহুরীর ওপর নির্মিত। মাতামুহুরী নদীটি বর্ষাকালে প্রবল প্রতাপ রূপ ধারন করে। দুকূল ছাফিয়ে পানিতে ভেসে যায়। নতুন রেল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ শত কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আমাদের এক্সপ্রেসটি চকরিয়া, ডালহাজারা, ইসলামবাদ অতিক্রম করে রামুতে এসে পৌছে। রামু ষ্টেশন বেশ বড় সড়ো। ষ্টেশনটি বেশ নান্দনিক। ইতোমধ্যে এটি বেশ জমে উঠেছে। রামু এলাকায় বৌদ্ধদের ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে। এটা বৌদ্ধজগতে বেশ সুপরিচিত। প্রতিনিয়ত শত শত পর্যটক ভরপুর থাকে।
রামু এলাকায় আমরা কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে খরস্রোতা নদী বাকখালী অতিক্রম করছি। নদীতে এখন পানি তেমন নেই। কিছুটা শুকনা, বাকখালী নদীতে কর্তৃপক্ষ রেলসেতু নির্মাণ করেছে। রেলসেতুটি বেশ বড়সড়ো নহে। মাঝারি আকারের। নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২ কোটি টাকার কিছু বেশী। বাকখালী সেতু অতিক্রম করে এক্সপ্রেসটি সম্মুখপানে মানে কক্সবাজার রেল সড়কের সর্বশেষ আইকনিক রেল ষ্টেশন এর দিকে ছুটছে। ধীর গতিতে ক্রমশ: আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। অবশেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের এক্সপ্রেসটি কক্সবাজার আইকনিক রেল ষ্টেশনে নোঙর করল। পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে স্বাগতম।
কক্সবাজার আইকনিক রেল ষ্টেশনটি সামুদ্রিক প্রাণী ঝিনুকের আদলে নির্মিত। ষ্টেশনটির আয়তন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫ বর্গফুট। এটি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। এটি বছরে দিবারাত্রি ৯২ হাজর যাত্রী সেবা দিতে সক্ষম। ৬ তলা বিশিষ্ট রেলওয়ে ষ্টেশনটিতে ট্রেন সংক্রান্ত কার্যক্রমের বাইরে শপিং সেন্টার, অফিস, মিটিং রুম, ভিআইপি কক্ষ, বিনোদন কেন্দ্র, স্পোর্টস সেন্টার, আবাসিক হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, প্রদর্শনী কেন্দ্র রয়েছে।
মূলত: কক্সবাজার অঞ্চলে বিশেষ ট্রেড সেন্টার হিসেবে কাজ করবে এ আইকনিক ষ্টেশন। এটি ইতোমধ্যে কক্সবাাজার এলাকায় জনারন্যে গমগম করছে। কলাতলী হতে এ ষ্টেশনটির দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। এ ষ্টেশনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে অস্থায়ী বাসষ্টেশনে নানা ধরনের বাইড-যানবাহন, দোকান পাট গড়ে ওঠেছে। ষ্টেশনটি প্রতিনিয়ত হাজার হাজার দর্শনার্থী, পর্যটক, ঢাকা-চট্টগ্রামগামী যাত্রী ও বিভিন্ন সেবা দানকারীর উপস্থিতিতে সরব হয়ে উঠেছে। আর কেউ আসছে দুর দূরান্ত হতে রেলও আইকনিক ষ্টেশন দেখতে। কেউ আসছে পণ্য বেচা কেনার উদ্দেশ্যে। ষ্টেশনে ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে আগত ট্রেন থেকে নামছে শত শত যাত্রী। চট্টগ্রাম-ঢাকাগামী যাত্রীরা ট্রেনে উঠছে। সব মিলে আইকনিক ষ্টেশনটি সর্বক্ষণ মানুষে মানুষে সরগম হয়ে উঠেছে। ট্রেন যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশনে পা ফেলতেই এগিয়ে আসছে পার্শ্ববর্তী নির্ধারিত অংশে টমটম, সিএনজিসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট যানবাহন। খানিক দূরে অস্থায়ী বাস ষ্টেশন। কলাতলী যাওয়ার জন্য অপেক্ষামান।
আনন্দ সম্মিলনে আসা যাত্রীরা কক্সবাজার এক্সপ্রেস থেকে প্লাটফর্মে নেমেই তিনতলা সিড়ি বেয়ে আইকনিক এর প্রধান গেইট দিয়ে বের হয়। পাশ্বেই ঝিনুক আদলে নির্মিত আইকনিক ছাউনী। এ সময়ে মিডিয়া কর্মীরা সেলফি তোলা, গ্রুপ ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। আনন্দে সম্মিলনে আসা মিডিয়া পারিবার ট্রেন ষ্টেশনে নামলেই একটি মিলন মেলায় রূপ ধারণ করে। যেন তিনশত পরিবারের সাত শতাধিক সদস্য এক সুতায় গাঁথা একটি অপূর্ব মেলবন্দন।
আনন্দ সম্মিলনে আসা তিনশত পরিবারের সাত শতাধিক সদস্য আইকনিক রেল ষ্টেশন থেকে বিভিন্নভাবে পূর্ব নির্ধারিত ৩টি স্টারমানের হোটেলে পৌছে যায়। হোটেলগুলো হলো কলাতলীর ডলপিন মোড়ের বেস্ট ওয়ের্স্টান, মধ্য কলাতলীর ওসান প্যারাডাইস, ইনানী সংলগ্ন কক্স টুডে। প্রেস ক্লাব এর সদস্য পরিবারকে হোটেল কর্তৃপক্ষ স্বাগত ও অভিনন্দন জানান। আগতদের ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীতে আনন্দ সম্মিলনের আসা সদস্য পরিবার নিজ নিজ কক্ষে চলে যায়।
আনন্দ সম্মিলনের কর্মসূচী অনুযায়ী দুপুরের লাঞ্চ এর ডাক পড়ে। আমরা ওসান প্যারাডাইস এর দু’টি বিশাল কক্ষে দুপুরের লাঞ্চে অংশ নিই। লাঞ্চের মেনু ছিল সাদা ভাত, পোলাউ, মুরগী, ডিম, সালাদ, সবজী, মাছ ও ড্রেজার্ট। খাওয়াটা মান সম্মত বলা যায়। বিকেলটা ছিল নিজ নিজ পছন্দের রুটিন ওয়ার্ক।
বিকেলটা ছিল রোদেলা বিকেল। কিছুটা শীতের আমেজ। সূর্যের আলো ছিল মোলায়েম। বাতাসে ছিল শীতল হাওয়া। সূর্যটা বঙ্গোপসাগরের উপর ঝুলছে। সাগরের ঢেউ তেমন নেই। সময়টা পর্যটন মওশুম। কক্সবাজার শহরে লক্ষাধিক পর্যটক গমগম করছে। হোটেল, মোটেল কোথাও ঠাই নেই। সড়কগুলোতে যানবাহন ছাড়াও মানুষে মানুষে ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে এসময় পর্যটকের ঢাল নামছে বলা যায়। আনন্দে সম্মিলনে আগত সদস্য পরিবারগুলো নিজ নিজ পরিকল্পনানুসারে কেউ সৈকত বালুচরে, কেউ সোনাদিয়া, কেউ মাতার বাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দর দর্শন, কেউ রামুর বৌদ্ধ মন্দির দর্শন, কেউ দরিয়ানগর ভ্রমণ, কেউ বার্মিজ মার্কেট, কেউ বিমান বন্দর স্টেশন, কেউ হোটেল কক্ষে দিব্যি ঘুমে কাতর হয়ে সময় কাটছে। আর কেউ বা প্রেস ক্লাব বা পত্রিকা পাড়ায় সময় কাটান। আর কেউ কেউ ডলফিন মোড় বা ইনানী মোড় হয়ে সাগরে নেমে সাঁতার কাটারত ছিল।
বন্ধু সাংবাদিক মো. ইসকন্দর আলী চৌধুরীসহ অন্যান্যদের সাথে মিলে ১৬ ডিসেম্বর এর শেষ সূর্যাস্ত দেখার অভিপ্রান্তে আমরা সৈকত বেলাভূমির বালুকা বেলায় হেঁটে হেঁটে পৌছি। তখন সাগর শয্যায় সূর্য ডুবি ডুবি করছে। সূর্যের কিরন নরম ও মোলায়েম রূপ ধারণ করছে। দুপুরের প্রচন্ড তাপ প্রদানকারী সূর্য্য এখন ক্লান্ত, অবসাদ গ্রস্ত ও বিশ্রামমুখী। এসময় মিডিয়া কর্মীরা সূর্যের লালিমা ধরে রাখতে সেলফিতে ব্যস্ত। এ এক আনন্দ ঘন সময়। সূর্য ক্রমশ: সাগর শয্যার দিকে নামছে। একটু পরেই সূর্য নীল জলে ডুব দেবে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। অবশেষে সূর্য তার দিনব্যাপী বিভিন্ন রূপ বদলে রণক্লান্ত সৈনিকের বেশে সাগর শয্যায় বিশ্রামগারে ডুব দেয়। সৈকতের বেলাভূমিতে লাখো লাখো পর্যটক সূর্য্যরে নীলজলে ডুব দেয়ার দৃশ্য অবলোকন করে। প্রবল প্রতাপধারী সূর্য, অসীম ক্ষমতাধর আলোক রশ্মিধারী সূর্য নীলজনে শায়িত হল। এসময় সাগর ছিল শান্ত। দর্শকেরা সূর্য্যরে বিদায় বেলায় বিষন্ন। আমরা আর সময় ক্ষেপন না করে ইনানী মোড়ের জামে মসজিদের সুমধুর আযান ধ্বনি অনুসরণ করে ফিরে আসি।
লাবনী পয়েন্ট হতে সরাসরি বাহারছড়াস্থ সাংবাদিকদের দ্বিতীয় আসাবস্থল নামে পরিচিত কক্সবাজার প্রেস ক্লাব। প্রেসক্লাবটি দ্বিতল। পুরানো বিল্ডিং। ক্লাব নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এটা ভেঙ্গে বহুতল দালান করার সিদ্ধান্তের কথা। কক্সবাজারের কর্মরত সাংবাদিক ও ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে আড্ডায় কিছু সময় অতিবাহিত করে প্রধান সড়কস্থ বার্মিজ মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যা ৮টায় ওসান প্যারাডাইসে ফিরি।
ওসান প্যারাডাইস গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঘন্টা দেড়ক আড্ডা। শেষে আমার অবস্থান কক্ষে (২২০ কক্ষ) কিছুটা বিশ্রাম শেষে আনন্দ সম্মিলন এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরানো দিনের গানে মজে যাই। র‌্যাফল ড্র এর কুপন ড্রপ করে সরাসরি ডাইনিং টেবিলে নৈশভোজে অংশ নিই। নৈশ ভোজ ছিল ব্যুফে। ভোজটা ছিল বেশ সুস্বাদু ও কিছুটা মানসম্মত। এর মধ্যে রাত দশটা ত্রিশ মিনিট। তারপর বিছানায় গিয়ে ঘুমের ঘোরে রাতটা কেটে দিই।
আনন্দ সম্মিলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের সকালটি ছিল বেশ মনোরম। শীতের আমেজ রয়েছে। ওসান প্যারাডাইসের ২২০ কক্ষে অবস্থান করছি। টিভি চ্যানেলে সকালের বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলছিল। টেলিফোন বাজল কর্তৃপক্ষের। বলল, প্রাতঃরাশ প্রস্তুত। ডাইনিং হলে আসুন। কুপন দিয়ে ডাইনিং হলে ডুকলাম। বুফে প্রাতঃরাশ। বিশাল আয়োজন। হরেক রকম আইটেম। ইচ্ছামতো খাওয়া যাবে। পরাটা, নান, ডিম, সুজি, পোলাও, ডিম মামলেট, নানা পদের ফ্রুটস। চা-কফিতো আছেই।
কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ ও সংস্কার হচ্ছে। এর খবরটা আগেই জানতাম। বিমান বন্দরটি সাগরের লাগোয়া। নতুন রানওয়ে হচ্ছে সাগরের পানির ওপর। এ বিমান বন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করতে পারবে। প্রাতঃরাশ সেরে বিমান বন্দর দেখে আসি। বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে ওসান প্যারাডাইস ফিরি। ফের হোটেল লবীতে আড্ডা। কক্ষে গিয়ে বিদায় এর প্রস্তুতি গ্রহণ। সাড়ে বারোটায় কক্ষ ছেড়ে লবীতে লাগেজ নিয়ে আসি।
ইতোমধ্যে জোহরের আজান হচ্ছিল। বন্ধু সাংবাদিক আব্দুল হাই এর কক্ষে গিয়ে জোহরের কসর নামাজ আদায় করি। ফের লবিতে ফিরে আসি। হোটেল কর্মকর্তাদেরকে বিদায় জানিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আইকনিক রেল ষ্টেশনে পৌঁছি। এক্সপ্রেস এর আসন নির্ধারিত। কক্সবাজার এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব এর তিনশত পরিবারের ৭ শতাধিক সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার আইকনিক কেন্দ্র ত্যাগের অপেক্ষা করছে। বিকাল দুই ঘটিকায় ট্রেনের বাঁশি বাজলো। ধীর গতিতে ট্রেন চট্টগ্রামমুখী হলো। ট্রেন ক্রমশঃ গতি পেল। ঘন্টায় পঞ্চাশ কি.মি. বেগে এক্সপ্রেসটি চলচিল। জানালার পাশে বসে দুই পাশের চলমান দৃশ্য অবলোকনে সময় কাটল। ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসটি রামু ষ্টেশন অতিক্রম করে। দুইপাশে ধান ক্ষেত পাহাড়, বিল-ঝিল, ঘড়-বাড়ি, দ্রুত আমাদের নিকট হইতে বিদায় নিচ্ছে। অগনিত শিশু কিশোর-কিশোরী, তথা নারী-পুরুষ আমাদেরকে উষ্ণ সম্ভাষণ জানায়। উল্লেখ্য প্রায় ৯২ বছর অপেক্ষার পর কক্সবাজারবাসী ট্রেনের দেখা পেল। এর আগে অনেকেই ট্রেনে চড়েনি। ট্রেন দেখেও নি।
ট্রেনেই দুপুরের লান্স করা হলো। আমরা ক্রমশঃ রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, দোহাজারী ষ্টেশন অতিক্রম করে চট্টগ্রামের কাছাকাছি চলে আসছি। খানহাট, কাঞ্চননগর, পটিয়া, গোমদন্ডী, ষোলশহর, ঝাউতলা ষ্টেশন হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নিরাপদে আনন্দ সম্মিলন যাত্রীদের নিয়ে কক্সবাজার এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনে পৌঁছে।

লেখক: চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ ও মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট এর সম্পাদক।