লোহাগাড়া উপজেলাধীন জ্ঞানী-গুণী, সুফী-সাধক ও পীর-আউলিয়ার চারণভূমি চুনতি ইউনিয়ন। বন-জঙ্গল ও খরস্রোতা ডলু নদী বিধৌত ইউনিয়নের পানত্রিশা গ্রাম। গ্রামের এক পাশে রয়েছে ডলু নদীর মানসকন্যা খরস্রোতা চাম্বী খাল। সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন নিয়ে এলাকার সমাজ হিতেষী কয়েকজন লোক এগিয়ে আসেন চাম্বী খালের উপর রাবার ড্যাম নির্মাণে মৎস্য চাষ ও কৃষি বিপ্লব ঘটায়ে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে।
হারিয়ে গেছে লোহাগাড়ার জনপদ থেকে অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য। সময়ের আবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির অনেক বিস্মৃত-স্মৃতি মানুষের মন-মানসিকতার দুয়ারে প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। কিন্তু প্রকৃতি প্রেমিকেরা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা সংস্কৃতির উৎস খুঁজে বের করে আধুনিকতার রূপ-রস-গন্ধ মিশ্রিত পর্যটন স্পট জনসম্মুখে তোলে ধরছেন। অত্র উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের জনপদে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যমন্ডিত চাম্বী লেক অন্যতম। এ’ চাম্বী লেক বর্তমানে এলাকার অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
চুনতি ইউনিয়নের চাম্বী এলাকা একটি জনপদ। অপরূপ শোভামন্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সবুজ-শ্যামল এ বনভূমির বন্য প্রাণীর বিচরণ, পাখির কলতান, পাতার মর্মর ধ্বনি, বনভূমির নিঃসঙ্গতা সব যেন জনপদের প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য এক লুকোচুরি খেলা। চাম্বী এলাকার উপর দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা চাম্বী খাল। উৎপত্তিস্থল গহীন অরণ্যের পাদদেশে। এলাকার অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ কৃষি নির্ভরশীল। চাম্বী খালে জয়নগর এলাকায় একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে কৃষি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি চিত্তবিনোদন স্পট হিসেবে গড়ে তুলা সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসেন প্রকৃতি প্রেমিকেরা।

চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা একটি গ্রাম। গ্রাম সংলগ্ন রয়েছে বনাঞ্চলের অফুরন্ত প্রাকৃতিক রত্মভান্ডার। বয়ে গেছে খরস্রোতা চাম্বী খাল। উচুঁ-নীচু,আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে মিলিত হয় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা ডলু নদীর সহিত। পানত্রিশা গ্রামের জয়নগর এলাকায় একটি রাবার ড্যাম স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান এবং পার্শ্ববর্তী ফারাঙ্গা গ্রামের বাসীন্দা আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৯৮ সালে রাবার ড্যাম স্থাপনে তাঁর চিন্তাধারা ক্রমশঃ গতিশীল হতে থাকে। ওই সময় সরকারের সহযোগিতায় রাবার ড্যাম স্থাপন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। ফলে, জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদ্যোক্তারা এ’স্থানকে চাম্বী লেক নাম দিয়ে এলাকার অন্যতম পর্যটন স্পট হিবেসে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গড়ে তুলেন।
২০১৫ সালে রাবার ড্যাম স্থাপনের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়। এলাকার উৎসাহি কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয়“ চাম্বী খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি”। পানি সম্পদ সেক্টরের অধীনে উক্ত স্থানে উত্তর-দক্ষিণ ২৫ মিঃ দৈঘের্যর একটি রাবার ড্যাম স্থাপিত হয়। ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারী এ’ রাবার ড্যাম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়। এ ছাড়া রাবার ড্যামের উপর নির্মিত হয়েছে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন একটি ফুট ব্রিজ।
অত্র উপজেলায় কোন চিত্তবিনোদন স্পট না থাকায় জ্ঞান পিপাসুরা অবকাশ যাপনে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে, চাম্বী লেক কর্তৃপক্ষ জ্ঞান পিপাসু দর্শনার্থীদের আনন্দদানে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলেন চাম্বী লেক পর্যটন স্পট। রাবার ড্যামের উপরিভাগে প্রায় ২ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে রয়েছে জমানো পানির স্তর। এতে বিভিন্ন এলাকার কৃষক যেভাবে উপকৃত হচ্ছেন এবং পাশাপাশি অসংখ্য চাষাবাদের জমি চাষের আওতাভুক্ত হয়। উপকৃত হচ্ছেন চাষীরা এবং ক্ষেত-খামার করতে পানি সেচের সুবিধে পাচ্ছেন উপর এবং নীচের অংশ সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা।
চুনতির এ’চাম্বী লেক বর্তমানে অত্র উপজেলার একমাত্র চিত্তবিনোদন স্পট। এমন কি এক প্রকার গ্রামীণ এলাকার মিনি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রকৃতির সবুজ-শ্যামল পরিবেশে এ’চাম্বী লেক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাক্ষণ মুখরিত অসংখ্য দর্শনার্থীদের পদচারণায়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকল বয়সের লোকদের আসা-যাওয়ার এ’বিনোদন স্পট অত্যাধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। চারিদিকে রয়েছে কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহল। সবুজ পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা এ’চিত্তবিনোদন কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম পানির ফোয়ারা, বন্য পশু-পাখির ভাস্কর্য,বিভিন্ন শ্রেণীর বানর,পানির উপর ভাসমান স্পিড বোট, প্যাডেল বোট, লাইফ বোট, ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ফ্যামিলি ট্রেন, বাচ্চাদের খেলার উড়েজাহাজ, ভুতের গুহাসহ বিভিন্ন প্রকার দর্শনীয় জিনিসপত্র। লেক চত্বরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, বিশ্রামাগার ও পিকনিক স্পট। লেকের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে “মায়া দ্বীপ”। যাতায়াতের সুবিধায় রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য ড্রাম ভেলা। পর্যটকদের অবকাশ যাপনের জন্য কতর্ৃপক্ষ একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট সেন্টার নিমার্ণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রাকৃতির সবুজ মেলায় নৈসর্গিক শোভামন্ডিত চুনতির এ’চাম্বী লেক বর্তমানে প্রকৃতি প্রেমিক ও উৎসুক জনতার আনাগোনায় মুখরিত। দক্ষিণ চট্টলার অন্যতম ব্যস্ততম উপ-শহর তথা লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী মোটর ষ্টেশন সংযুক্ত দরবেশ হাট ডি.সি সড়ক দিয়ে সোজা দক্ষিণে পুটিবিলার এমচর হাট পেরিয়ে সামান্য দক্ষিণে এ চাম্বী লেকের অবস্থান।
চাম্বী লেক পর্যটন কেন্দ্র বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা ও চুনতি ইউনিয়নের একাধিকবার নিবার্চিত সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, চুনতি চাম্বী লেক চিত্ত বিনোদন স্পট । বর্তমানে এ চাম্বী লেক মিনি পর্যটনকেন্দ্রের সমতূল্য। গ্রামীণ পরিবেশে এ চাম্বী লেক গড়ে ওঠে রূপ-রস ও আনন্দদানে মুগ্ধ করছে দর্শনার্থীদেরকে। দূর-দূরান্তের এলাকা থেকে আগত দর্শনার্থীরা এই চাম্বী লেকে এসে আনন্দ উপভোগ করছেন। তাঁর ধারণা, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ফেলে এর সুযোগ-সুবিধে, সুনাম ও প্রচার আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। তা’ই এ লেকটি পূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র পরিণত করতে সরকারের শুভদৃষ্টি দাবি করেছেন তিনি।
চাম্বী খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শিক্ষাবিদ মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, চুনতির পানত্রিশা একটি স্বনামধন্য গ্রাম। চাম্বী খালকে কেন্দ্র করে এ’গ্রামের পরিচিতি আরো ছড়িয়ে পড়েছে। ত্রিমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এলাকার জয়নগরস্থ খরস্রোতা চাম্বী খালের উপর রাবার ড্যাম স্থাপিত হয়। চিত্তবিনোদনে আনন্দ পাচ্ছে দর্শনার্থীরা। পানি সেচ ব্যবস্থায় কুষিপণ্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষে মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধিকরণ প্রভুতি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে গড়ে ওঠেছে এ চাম্বী লেক প্রকল্প বা পর্যটন কেন্দ্র। তিনি আরো বলেন, উক্ত পর্যটন স্পট চাম্বী লেক সংস্কারের কাজ চলছে সরকারের আর্থিক সহযোগিতায়। উক্ত সংষ্কারের কাজ সম্পন্ন হলে উক্ত চাম্বী লেকের নান্দনিক শোভা ও সুনাম আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে এবং তাতে দর্শনার্থীর সংখ্যা ও আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে তাঁর একান্ত বিশ্বাস।