শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

প্রতিবন্ধী মো. আলীর সংগ্রাম ও সাফল্য

দু’হাত নেই, পায়ে লিখেই এমবিএ পাস আলী

লোহাগাড়া প্রতিনিধি

প্রকাশ : ৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:১৭

জন্মের পর থেকেই তাঁর দুটি হাত নেই। কিন্তু সেই অভাবকে কখনো দুর্বলতা নয়, বরং শক্তিতে রূপ দিয়েছেন তিনি। জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ তিনি দাঁড়িয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। লোহাগাড়ার দূর্গম পাহাড়ি জনপদ বড়হাতিয়া ইউনিয়নের হরিদাঘোনা গ্রামের দুই হাতবিহীন প্রতিবন্ধী মো. আলী পা’য়ের লিখনেই সম্পন্ন করেছেন উচ্চশিক্ষা— এমবিএ পাস করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে। এখন তাঁর একটাই স্বপ্ন— একটি সরকারি চাকরি, যাতে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে হতে পারেন প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভরশীল।

‘আমি জন্মগতভাবে দুই হাতবিহীন। কিন্তু পা আছে, তাই হাল ছাড়িনি’— কথাগুলো বলছিলেন মো. আলী। তিনি জানান, শৈশব থেকেই মা ও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় পা দিয়ে লেখা, খাওয়া, এমনকি খেলাধুলাও করতেন তিনি। মা ছিলেন নিরক্ষর, তবুও সন্তানের পাশে ছিলেন প্রতিটি মুহূর্তে। প্রতিবেশীদের নিরুৎসাহ, সমাজের কটূচোখ, দারিদ্র্যের দংশন— কিছুই থামাতে পারেনি আলীর অদম্য পথচলা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তাঁকে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউই নিতে চায়নি এই হাতবিহীন শিশুকে। অবশেষে উত্তর বড়হাতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী তাঁকে ভর্তি করে নেন এবং লেখার জন্য বিশেষ উৎসাহ দেন। সেই শিক্ষক স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘যেদিন প্রথমবার তাঁর পা’য়ে লেখা দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম— এই ছেলেটি একদিন ইতিহাস তৈরি করবে।’

সেই ভবিষ্যদ্বাণীই আজ সত্য। আলী প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে বিবিএ (ব্যবস্থাপনা) সম্পন্ন করেন এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর এই শিক্ষাজীবনে সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা ও চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি বড় সহায়ক ছিল।

চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক এডিসন কান্তি দে বলেন, ‘কারো সহযোগিতা ছাড়াই আলী পায়ে লিখে বিবিএ ও এমবিএ পাস করেছে— এটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মনোবলই তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ।’

মো. আলীর মা সামশুন্নাহার চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘লোকজন বলত, এই ছেলেকে নিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু আজ আমার আলী সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছে।’

নিজের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আলী বলেন, ‘আমি চাই সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রমাণ করতে, প্রতিবন্ধকতা নয়, ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে সফল করে।’

লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দুই হাতবিহীন হয়েও পায়ে লিখে এমবিএ পাস করা নিঃসন্দেহে বিরল কৃতিত্ব। তাঁর চাকরি প্রাপ্তির বিষয়ে আমরা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করব।’

মোঃ আলীর গল্প শুধু একজন প্রতিবন্ধীর সাফল্যের নয়— এটি এক অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতিচ্ছবি, যা মনে করিয়ে দেয়— মানুষের আসল শক্তি তার শরীরে নয়, তার বিশ্বাসে। জীবনের সীমাবদ্ধতা জয় করে স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলা এই তরুণ আজ পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতিটি যুবকের কাছে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।

ভিডিও