কখনো জনপদের গাছের ডগায় চোখ তুলে তাকালেই দেখা যেত সারি সারি ঝুলন্ত বাসা। বাতাসে দুলছে পাতার সঙ্গে পাখির বাসাও। সেখানে বসে কিচিরমিচির করছে সৌখিন বাবুই পাখিরা। তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেলগাছের মধ্যে তারা যেন প্রকৃতির নিজস্ব স্থপতি। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য শুধু স্মৃতিতে, আর গল্পে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় আজ আর চোখে পড়ে না এমন দৃশ্য।
একসময় এই বাবুই পাখিরা ছিল গ্রামীণ জীবনের অংশ। তাদের নিপুণ ঠোঁটের কারুকাজে তৈরি ঝুলন্ত বাসা যেন শিল্পীর হাতের কাজ। খেজুরপাতা, তালপাতা কিংবা নারিকেলপাতা থেকে আঁশ ছিঁড়ে, সূক্ষ্মভাবে গেঁথে তারা বানিয়ে নিতো দোলনাসদৃশ ঘর। সেখানে ডিম পাড়ত, বাচ্চা ফুটাতো, আর দিনের পর দিন ভেসে থাকতো বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
লোকজ জীবনে এই দৃশ্য ছিল আনন্দের, বিশেষ করে শিশুদের কাছে। বিকেলবেলা মাঠ থেকে ফিরে শিশুরা তাকিয়ে থাকত গাছের ডগার দিকে—কোথায় ক’টা বাসা, কোনটায় পাখি ঢুকল, কোনটা দুলছে বাতাসে। কখনো আবার কৌতূহলী কেউ ঢিল ছুঁড়ত বাসার দিকে, পাখি উড়ে যেত আতঙ্কে। অথচ তাতেও ছিল গ্রামীণ জীবনের এক সরল আনন্দ।
কিন্তু সেই দিনগুলো এখন অতীত। বসতভিটার সম্প্রসারণ, সড়ক নির্মাণ আর অবাধ বৃক্ষনিধনে হারিয়ে যাচ্ছে সেই আশ্রয়স্থল। তালগাছ, খেজুরগাছ বা নারিকেলগাছের সংখ্যা কমে আসায় বাবু পাখিরা এখন যেন নিঃস্ব। তারা ছেড়ে গেছে গ্রাম, খুঁজে নিয়েছে নতুন গন্তব্য। হয়তো দূরের বনভূমি কিংবা অন্য কোনো জনপদে।
উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা গ্রামে এখনো কিছুটা স্মৃতি রয়ে গেছে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ির পাশে উঁচু এক নারিকেলগাছে আজও ঝুলছে কয়েকটি বাবুই পাখির বাসা। তিনি বলেন, প্রতি বছর এই গাছে বাবু পাখিরা এসে বাসা বাঁধে। সকাল-বিকেল তাদের কিচিরমিচিরে চারপাশ ভরে ওঠে। তাদের এই ফিরে আসাই আমাদের কাছে আনন্দের। তাদের আনাগোনা ও কিচির-মিচির গুঞ্জনে এক চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। বাবু পাখির বাসাগুলো আমাদের সকলের কাছে খুবই প্রিয়।
প্রবীণরা বলেন, যে গ্রামে বাবু পাখির বাসা দেখা যায়, সেই গ্রামটা জীবন্ত থাকে। আজ সে প্রাণ নেই। আকাশটা নীরব। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ ও পাখির জন্য নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে এমন আরও অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাবে সময়ের স্রোতে।