বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অনতিবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, আপানারা বিপ্লবী সরকার নন, রেগুলার সরকারও নন, আপনারা অন্তর্বর্তী সরকার। আপনাদের কাজ হচ্ছে দ্রুততার সাথে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। অন্যথায় যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি, সেই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আজ শনিবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন চত্বরে সিপিবি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি আয়োজিত এক গণসমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহিন হোসেন প্রিন্স অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। এখন জনগণের হাতে দ্রুততার সাথে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করুন। অনতিবিলম্বে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনুন, জিনিসপত্রের দাম সহনীয় করুন। আমাদের দেশবাসী ভোটবঞ্চিত। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে, এটা আপনার অন্যতম ম্যান্ডেট। তার মানে হঠাৎ করে একটা নির্বাচন নয়, নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দেন।
সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনতিবিলম্বে আলোচনা শুরু নতুন নতুন তত্ত্ব আনা হচ্ছে- সংস্কার, সংস্কার, সংস্কার। আমরা বলছি- সংস্কারের আগে আলোচনা করুন। উনারা নাকি আলোচনা নয়, কর্মশালা করবেন। আমরা বলি- এনজিওর কর্মশালা চাই না, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থার পুরো সংস্কার করুন। নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং ভোট দেয়ার অধিকার লাগবে। টাকা, পেশিশক্তি, প্রশাসনের কারসাজিমুক্ত ভোট করার সুযোগ তৈরি করুন। তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করুন, দলীয়করণমুক্ত করুন। এটাই সংস্কারের মূল কাজ। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তিনমাস লাগবে কেন ? ১৫ দিনেই তো সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকুন। পতিত স্বৈরাচার সম্পর্কে সজাগ থাকুন। দেশের মধ্যে আবার দুর্বৃত্তগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের কিন্তু কোনো দল নেই। এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার এসে গেছে। সচিবালয়ে আগে ছিল এক গ্রুপের তাফালিং, এখন আরেকগ্রুপ তাফালিং শুরু করেছে। সুতরাং এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার নয়, এক চাঁদাবাজের পরিবর্তে আরেক চাঁদাবাজ নয়।
সরকারের উদ্দেশে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, কাজ ঠিকঠাক করুন, আমাদের সহযোগিতা পাবেন, জনগণের সহযোগিতা পাবেন। কিন্তু কাজ না করে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করবেন না, অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, শহিদের রক্তকে কলুষিত করবেন না। আজ কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কেন বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ? আওয়ামী লীগ তার স্বৈরাচারি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছে, আমরা সেটা মানি না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমরা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেব না। বাহাত্তরের সংবিধান আমাদের আরেকটা অর্জন, সেটাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেব না।
তিনি আরও বলেন, মাত্র সাড়ে তিনমাস আগে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা উন্নয়নের তত্ত্ব হাজির করে একযুগেরও বেশিসময় ধরে দেশে লুটপাটের রাজত্ব, ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাংলাদেশের মানুষের একটি শেষ অস্ত্র ছিল ভোট, তারা সেটাকেও ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসক শেষপর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানের দেশ, শেষপর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে তাদের পতন হয়েছে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে স্বৈরশাসক। যারা ক্ষমতায় আছেন বা আগামীতে আসবেন- এ ইতিহাস মনে না রাখলে তাদেরও কিন্তু একই পরিণতি হবে।
গণসমাবেশে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে তিনমাস হয়ে গেছে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমেনি, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে, সিন্ডিকেট বহাল আছে, বাজারের অবস্থা ভয়াবহ। আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। এর অর্থ হচ্ছে, স্বৈরাচারি ব্যবস্থা উনারা ভাঙতে পারেননি। ব্যবস্থা বদল করতে না পারলে কিছুই হবে না। এ কাজ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েও হবে না। এজন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে লাগবে, বাম বিকল্প শক্তি লাগবে। আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যে সমাজে সবাই যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাবে। অমুক নেতার আত্মীয় পরিচয়ে, মোবাইলে হ্যালো বলে কেউ যেন চাকরি কেড়ে নিতে না পারে, এমন ব্যবস্থা চাই। এই ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামে আমরা আছি, এটা আরও জোরদার করতে হবে। জনগণকে বলবো- ৫৩ বছর তো অমুক দল, তমুক দল দেখেছেন, অমুক মার্কা, তমুক মার্কা দেখেছেন, এবার কাস্তে মার্কাকে দেখুন। কাস্তে মার্কাই আপনাদের জনজীবনের সত্যিকারের বদল ঘটাতে পারবে।
চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহার সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃণাল চৌধুরী ও জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য উত্তম চৌধুরী, ফরিদুল আলম, দক্ষিণ জেলা সিপিবির সভাপতি কানাই লাল দাশ ও সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন, নিউমার্কেট, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লা হয়ে চেরাগি পাহাড় মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।