আটহাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আছে পৃথিবীতে চৌদ্দটি। ওই উচ্চতায় অক্সিজেন থাকে ভূপৃষ্ঠের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। ফলে মানবদেহ সচল রাখতে পর্বতারোহীরা ব্যবহার করেন কৃত্রিম অক্সিজেন। আর বাংলাদেশের স্বনামধন্য পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী ইতিহাস গড়লেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আটহাজারি শিখর আরোহণ করে। তিনি গত ২৬ অক্টোবর ভোরে স্পর্শ করেছেন পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট মানাসলু (২৬,৭৮১ ফুট) চূড়া। এটি বাবরের ৪র্থ আটহাজারি শৃঙ্গে সফলতা। বাবর ছাড়াও একইদিনে মানাসলু পর্বতের শিখরে আরোহণ করেছেন বাংলাদেশের আরেক পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ। এটি তানভীরের প্রথম আটহাজারি শিখর অভিযান ও প্রথম অভিযানেই এসেছে এই সাফল্য।
‘মানাসলু অ্যাসেন্টঃ ভার্টিক্যাল ডুয়ো’ শীর্ষক এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। আজ ৪ অক্টোবর সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে অভিযান পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ও পতাকা প্রত্যর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে দুই পর্বতারোহী ছাড়াও পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ‘সামুদা’ এর চিফ বিজনেস অফিসার বিকাশ কান্তি দাস এবং ভিজুয়াল নিটওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ নুর ফয়সাল উপস্থিত ছিলেন। বিকাশ কান্তি দাস তাঁর বক্তব্যে সামনের দিনগুলোতেও দেশের তরুণ অ্যাথলেটদের পাশে দাঁড়ানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেন। স্যাম-বন্ড সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত হয়েছে বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য যে, এই দুঃসাহসিক অভিযানে আরো পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন গিগাবাইট বাংলাদেশ, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, সিনোভেস্ট, সিয়েরা-রোমিও, আদিবা ফুটওয়্যার, ফোরএস অ্যাডভান্স টেকনোলজিস, জেনোভার্স, সোর্স এসোসিয়েটস, আইলেট ব্যাংকার্স, কাজী এগ্রো এবং ফ্রিয়েসভা। ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ক্লাবের পাবলিক রিলেশন্স সেক্রেটারি আশরাফুল আরেফীন আসিফ। আর পুরো অভিযানের ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন ফরহান জামান।
অনুষ্ঠানের পরিচালক আশরাফুল আরেফীন আসিফ বলেন, ‘নেপালের মানসিরি হিমাল রেঞ্জে অবস্থিত বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে আমাদের দুই পর্বতারোহী বাবর এবং তানভীরের সৌজন্যে একই দিনে দুইবার উড়ল আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। ব্যাপারটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বিশাল গর্বের। আমাদের ছেলেরাও যে পর্বতারোহণ নামক স্পোর্টসে দারুণ কিছু করে দেখাতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাবর-তানভীর জুটি। সামনের দিনগুলোতেও আমরা তাঁদের দুজনের কাছ থেকে দারুণ সব আরোহণের দেখা পেতে উন্মুখ হয়ে আছি। দেশের পর্বতারোহণ জগতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেও এই দুজনকে সমূহ ভূমিকা রাখতে দেখতে চাই সামনের দিনগুলোতে।’
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শিখর আরোহণের। বাবর ইতঃপূর্বে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত এভারেস্ট, চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে এবং দশম সর্বোচ্চ পর্বত অন্নপূর্ণা-১ নামে তিনটি আট হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আরোহণ করেন। তবে অক্সিজেনবিহীন এবারের আরোহণ দেশের পর্বতারোহণকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। সংবাদ সম্মেলনে বাবর বলেন, ‘ভেতো আর ঘরকুনো হিসেবে বাঙালির দুর্নাম বহুদিনের। এই তথাকথিত ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে চলছি আমরা বহুদিন ধরে। পশ্চিমারা কত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে হিমালয় থেকে দারুণ সব আরোহণের কৃতিত্ব ঝুলিতে নিয়ে বাড়ি ফেরে। অথচ আমাদের বাড়ির পাশের হিমালয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আমাদের কৃতিত্বের ছাপ খুব একটা বেশি নয়। নানান দেশের অসীম শক্তিধর পর্বতারোহীদের দেখে আগে ভাবতাম, আমি বা আমরাও যদি আট হাজার মিটার বা তার অধিক উচ্চতার শিখরে কৃত্রিম অক্সিজেনবিহীন আরোহণ করতে পারতাম! অবশেষে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিলো। এই অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। আমি আশা করব, আমার পরের পর্বতারোহীরা আরো নতুন সব আইডিয়া নিয়ে পর্বতে যাবে। প্রতিটা পর্বত চূড়ায় লাল-সবুজ পতাকা হাতে এই মাটির কেউ দাঁড়ালে, দেশটাও তাঁর সাথে কিছুটা হলেও উপরে ওঠে বলে আমি বিশ্বাস করি। আশা করি, পরের পর্বতারোহীরাও সেই ধারা অব্যাহত রাখবে। তবে পর্বতে যাওয়াটা তো কোন খেয়ালি ব্যাপার কিংনা দিবাস্বপ্ন নয়। এর পেছনে দীর্ঘ সাধনা আর প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। প্রস্তুতির ব্যাপারটাতে সবাই যাতে আরো বেশি মনোযোগ দেয়, সেই প্রত্যাশা থাকবে আমার। আর আমি চাই ১৪টি আটহাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই চড়তে। সবেমাত্র ৪টি হলো, বাকি আছে আরও ১০টি। আশা করি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লাল-সবুজ পতাকা হাতে বাকি ১০টি পর্বতের চূড়ায়ও আমি দাঁড়াতে পারব।’
ইতঃপূর্বে আটহাজারি শিখরে সফল সব বাংলাদেশি পর্বতারোহীই পর্বতারোহণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত। এ থেকে অনেকের ধারণা ছিল, অতি-উচ্চ পর্বতে সফলতা পেতে বিদেশে গিয়ে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের বিকল্প নেই। এই ধরনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তানভীরের নেই। ওর সম্বল দেশে সীমিত সুবিধার মধ্যে অনুশীলন আর ইচ্ছাশক্তি। অনুষ্ঠানে তানভীর বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে ওই অর্থে পর্বত কিংবা হিমবাহ নেই, সেহেতু দেশের বাইরে গিয়ে পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাতে আমার ঘাটতি ছিল। তবে দেশে ক্লাবের সদস্যদের সাহায্যে প্রশিক্ষণ, নিয়মিত অন্যান্য অনুশীলন আর একাগ্রতার মাধ্যমে আমি সেই ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছি। এই ব্যাপারে অনুশীলনের প্রতি আমার একাগ্রতা আমাকে প্রভূত সাহায্য করেছে। আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত সব সময়ই কঠিন। তাঁর উপর এটি ছিল আমার প্রথম আট হাজার মিটার পর্বত। নানান শন্কা নিয়ে আমি পর্বতের পাদদেশে পৌঁছেছি। তবে একবার পাতলা বাতাসের রাজ্যে হাজির হতেই আমার সকল শন্কা কেটে গেছে। আমার এতদিনের প্রস্তুতি এ ক্ষেত্রে আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। একইসাথে সহ-অভিযাত্রী হিসেবে বাবরের মতো অভিজ্ঞ কাউকে পাওয়াটাও ছিল দারুণ ব্যাপার। আট হাজার মিটারের পাতলা বাতাসের রাজ্যে নিশ্বাস নেওয়াটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। সেটাতে যেহেতু উতরে গেছি, ভবিষ্যতে আমি চোখ রাখছি অন্যান্য উঁচু পর্বতগুলোর দিকে। আর এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড়ো সহায়ক হবে পর্বতকে ঘিরে আমার প্রস্তুতি। আমি সব সময় যে-কোন স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার যে চলমান শারীরিক-মানসিক প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়াতে বিশ্বাসী। সেটাতে আস্থা রেখেই অন্যান্য উঁচু শৃঙ্গগুলো ছুঁতে চাই আমি।’
তানভীর ও বাবর বাংলাদেশ থেকে নেপালে গিয়েছেন ৫ সেপ্টেম্বর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৭ সেপ্টেম্বর তাঁরা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তাঁরা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দুইদিন বিশ্রাম তাঁরা শুরু করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তাঁরা নেমে আসেন। একদিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (৬৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ (৬৭০০ মিটার) এ রাত কাটিয়ে শেষ করেন অতি উচ্চতা ও নিম্ন তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব। একদিন বেসক্যাম্পে বিশ্রামের পর আসে চূড়ান্ত চেষ্টার ক্ষণ। তানভীর ২২ সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প থেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এদিকে বাবর একদিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ। ২৪ সেপ্টেম্বর দুইজনেই ক্যাম্প-৩ তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ (৭৪০০ মিটার)। বাকিবেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাঁদের পরম আরাধ্য চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তাঁরা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে।
বাবর আলী দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর সাধারণ সম্পাদক এবং তানভীর আহমেদ এই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। তানভীর গত বছর অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম সামিট করেন, প্রথম বাঙালি হিসেবে যেই পর্বত ২০২২ সালে সামিট করেছিলেন বাবর। ‘ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশ’ এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত তানভীর কিশোরগঞ্জ সদরের খরমপট্টি নিবাসী এড. তারেক উদ্দিন আহমদ এবং শিরীন আহমেদ এর প্রথম সন্তান এবং নিজেই এক কন্যা সন্তানের পিতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এর ২০০৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচে এমবিবিএস পাশ করা ডা. বাবর আলী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগম এর দ্বিতীয় সন্তান।