২১ নভেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট। ঢাকা শহরের বাসিন্দারা কেউ বা বাজার নিয়ে ফিরছে আবার কেউ কর্মহীন দিনে আয়েশি ভঙ্গিতে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলছে। কেউবা আয়েশ করে চা খাচ্ছে আর পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছে। আর আজকালকার ছেলে-মেয়েরা রাত জেগে এ বেলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঠিক এমনি সময়ে ঢাকাসহ আশেপাশের অঞ্চল কেঁপে উঠেছে ভূমিকম্পের উচ্চ মাত্রার ঝাঁকুনিতে। বাসিন্দারা বলছেন ঝাঁকুনির মাত্রা ছিল ভয়াবহ। এত মারাত্বক ঝাঁকুনি এতদ অঞ্চলের বাসিন্দারা বিগত বছরগুলোতে কখনো দেখেননি বলছেন যদিও নিয়ম করে মাঝে মাঝেই এসব অঞ্চলে ঝাঁকুনি দেখা দেয়। রিখটার স্কেলে এ ঝাঁকুনির মাত্রা ছিল ৫.৭। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে উত্তর-পূর্বে নরসিংদি এলাকায়। এরপর ২২ নভেম্বর সকাল ১০.৩৯ মিনিটে আবারও মৃদু ঝাঁকুনি দেখা দেয় যার মাত্রা ছিল ৩.৩। একই দিন সন্ধ্যা ৬.০৬ টায় আবারো ঝাঁকুনি যার মাত্রা ছিল ৩.৭। এক সেকেন্ড পরে ৬.০৭টায় আবারো কম্পন যার মাত্রা ছিল ৪.৩। দেখা গেছে সাড়ে ৩১ ঘন্টার ব্যবধানে ৪ বার কম্পন হয়েছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে প্রায় ৬ শতের অধিক। ঢাকায় কমবেশি ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, অনেকগুলো ভবন পাশের ভবনের উপর হেলে পড়েছে। উত্তরার একটি নির্মাণাধীন ভবনকে বাতাসে বড়গাছের দোল খাওয়ার মতো একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে দোল খেতে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন উঁচু ভবনের প্রচন্ড ঝাঁকুনি খাওয়ার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। পুরান ঢাকায় উপরের তলার রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে মেডিকেল পড়ুয়া একজন ছাত্র মারা গেছে। নারায়নগঞ্জে দেয়াল চাপায় শিশু নিহত ও শিশুর মা মারাত্বক আহত হয়েছে। নরসিংদির উৎপত্তিস্থলে মাটি মারাত্বকভাবে ফেটে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম ঢাকায় ভূমিকম্পে প্রাণহানি হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কমবেশি ঝাঁকুনি অনুভূত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আতংকের বিষয় হচ্ছে ভূমিকম্পের সময় ছোট-বড় ভবন থেকে সবাইকে দৌড়ে নিচে নামতে দেখা গেছে। এক তলা বা দুই তলার বাসিন্দারা হয়তো দ্রুততর সময়ে নিচে নামতে পেরেছে। কিন্তু তার উপর তলার বাসিন্দারা বেশিরভাগই সিড়িতে রয়ে গেছে। তারা যতক্ষণে নেমেছে ততক্ষনে কম্পন শেষ হয়ে গেছে। কেননা ভূমিকম্প এমনিতে বেশি সময় ধরে থাকে না। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। যেমন ২১ নভেম্বরে কম্পনের সময় ছিল মাত্র ৮/৯ সেকেন্ডের মতো। বাকিগুলোর সময়ও প্রায় কাছাকাছি। পৃথিবীর সব বড় বড় ভূমিকম্প অল্প কয়েক সেকেন্ডই স্থায়ীত্ব ছিল।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, অল্প অল্প মাত্রার ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁদের মতে ঢাকা বা এর আশে পাশে মধুপুর ফল্ট অঞ্চলে যেকোন সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ হুমায়ূন আখতার বলেছেন, ‘বর্তমানে প্লেট বাউন্ডারিতে যে শক্তি লক অবস্থায় ছিল-তা আনলকিং শুরু হয়েছে। ঘন ঘন কম মাত্রার ভূমিকম্পগুলো এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হওয়ার মতো বিপুল শক্তি ভূ-তকের মধ্যে জমা হয়ে আছে এবং এই শক্তি যেকোন সময় বের হতে পারে’।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা মোতাবেক যদি দেশে বড় ধরণের ভূমিকম্প দেখা দেয় তাহলে ধ্বংসযজ্ঞ হবে ভয়াবহ। কেননা আমাদের বেশিরভাগ ভবনই বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি, উদ্ধারের পথও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরু। তাছাড়া হুড়োহুড়ি করে নামার অভ্যাস আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমরা সচেতন না হয়ে হুড়োহুড়ি করি। এতে করে নিজেকেও বিপদে ফেলি -অন্যের জন্যও বিপদ ঢেকে আনি। অথচ আমরা যদি ভূমিকম্পে করণীয় জেনে মাথা ঠান্ডা রেখে সচেতনতার সাথে দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি, তাহলে প্রাণহানির মাত্রা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এজন্য আমাদের সকলকে কম্পনের সময় করণীয় বিষয় জানতে হবে, পরিবারের সকলকে জানাতে হবে, সচেতন হতে হবে।
ভূমিকম্প শুরু হলে প্রথম কাজ-দৌঁড়াবেন না, বাঁচার চেষ্টা করুন। ঢাকার অধিকাংশ ভবনই ৫-৭ বা তারও বেশি তলার এপার্টমেন্ট। এ ধরনের ভবনে ভূমিকম্পে বাঁচা বা মারা যাওয়ার সবচেযে বড় পার্থক্য তৈরি করে-আপনার প্রথম ১০-২০ সেকেন্ডে নেওয়া সিদ্ধান্ত। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে দৌড়ে সিঁড়ির দিকে যাওয়াই সবচেয়ে সাধারণ ভূল-এবং এটিই সবচেয়ে বেশি মুত্যুর কারণ।
কম্পন শুরু হলে যে ভূলগুলো প্রাণঘাতী হতে পারে-
১. সিড়ির দিকে দৌড়ানো- বিশে^র বিভিন্ন্ স্ট্রাকচারাল রিসার্চ অনুযায়ী নিচের তলা ধসে পড়লে ওপরের তলা সরাসরি সিঁড়ির উপর ভেঙ্গে পড়ে। ধাক্কাধাক্কি, ভিড়, আলো নিভে যাওয়া ইত্যাদির কারনে ৯০% মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত সিঁড়িতেই ঘটে।
২. বারান্দায় যাওয়া- বারান্দার রেলিং ভূমিকম্পে একাধিক দিক থেকে চাপ পায়, যা সহজেই ভেঙে নিচে পড়ে যেতে পারে। (সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে পুরাণ ঢাকায় এভাবে রেলিং ভেঙে পড়েছিল)
৩. লিফট ব্যবহার-কম্পনে লিফট জ্যাম, দড়ি ছিড়ে যাওয়া, মাঝপথে আটকে পড়া-সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে।
বাঁচার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো
১. বেডরুমে থাকলে- খাটের নিচে ঢুকে মাথা ঘাড় ঢেকে রাখুন। খাট ভেঙে পড়লেও ভেতরে ‘‘ লাইফ ট্রায়াঙ্গেল’’ তৈরি হয় যা নিরাপদ।
২. ড্রয়িং/ডাইনিংএ থাকলে-মজবুত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন। কাঁচ, জানালা, বড় ফ্রেম, শোকেস থেকে দুরে থাকুন।
৩. কিছুই না পেলে- দেয়ালের কোণে বসে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন। একে বলা হয় ‘সেফ কর্ণার পজিশন’। ভবন ধসে পড়লেও সাধারণত কোণার অংশ সম্পূর্ণ চাপে ভাঙে না।
৪. বাথরুম- অনেক সময় সবচেয়ে শক্ত অংশ। বালতি/হেলমেট মাথায় দিলে আঘাত কমে।
৫. মাথা রক্ষার ব্যবস্থা- হেলমেট, বালতি, ঝুড়ি, ব্যাগ-যা পাবেন তাই মাথার উপর চেপে ধরুন। কেননা ভূমিকম্পে যেকোন ভাঙা বস্তু মাথা লক্ষ্য করে পড়ে।
১ম বা ২য় তলায় থাকলে আপনি সবচেয়ে ভাগ্যবান। এই দুই তলায় থাকা মানুষদেরই নিরাপদে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এ অবস্থায় থাকলে আপনি যা করবেন-
– কম্পন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই দরজা খুলে রাখুন, জ্যাম হয়ে গেলে বের হতে পারবেন না।
– ঘরে হেলমেট থাকলে মাথায় পরে নিন, অন্যদেরকে পরতে বলুন।
– প্রথম ১৫-২০ সেকেন্ডে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামুন।
– ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সম্ভব হলে আশপাশের সবাইকে বের হতে বলুন।
– যদি পারেন দ্রুত বৈদুতিক সুউচ ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ করে দিন।
– কোন কিছু সঙ্গে নেওয়ার জন্য অযথা সময় নষ্ট করবেন না, এগুলো পরে পাওয়া যাবে।
– এসময় লিফট ব্যবহার করবেন না।
– যদি ঘর থেকে বের হওয়া না যায়-সেক্ষেত্রে ইটের গাঁথুনি দেওয়া পাকা ঘর হলে ঘরের কোণে এবং কলাম ও বিমের তৈরি ভবন হলে কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন।
– আধা পাকা বা টিন দিয়ে তৈরি ঘর থেকে বের হতে না পারলে শক্ত খাট, চৌকি বা টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন, পারলে মাথায় বালিশ রাখুন।
-বাইরে এসে ভবন থেকে অন্তত ১০০ ফুট দুরে দাঁড়ান।
– বিদ্যূতের খুঁটি তার গাছের নিচে দাঁড়ানো উচিত নয়/দাঁড়াবেন না।
– সম্ভব হলে খোলা মাঠে অবস্থান নিন।
-গাড়িতে থাকলে যথাসম্ভব নিরাপদ স্থানে থাকুন, কখনো সেতুর উপর গাড়ি দাঁড় করাবেন না।
ধ্বংসস্তুপে আটকে গেলে কি করবেন (ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ প্রোটোকল)-
– চিৎকার করবেন না, ধুলো ফুসফুসে ঢুকে শ্বাসনারী বন্ধ করে দিতে পারে।
– হুইসেল থাকলে বাজান- দূর থেকে সহজে শোনা যায়।
– হুইসেল না থাকলে দেয়াল বা পাইপে ৩ বার করে টোকা দিন-এটি আন্তর্জাতিক ঝঙঝ জবংপঁব ঝরমহধষ।
– মোবাইলের টর্চ অন রাখুন, কিন্তু কথা বলবেন না, ব্যাটারি বাঁচাতে হবে।
– মুখে কাপড় চেপে রাখুন, -ধুলো কম ঢুকবে, শ^াস নেওয়া সহজ হবে।
– যদি বহুতল ভবনের উপরের দিকে কোন তলায় আটকা পড়েন আর বেরিয়ে আসার কোন পথই না থাকে, তবে সাহস হারাবেন না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, ভেবে দেখুন উদ্ধারকারী পর্যন্ত আপনার চিৎকার পৌঁছাবে কি না। যেকোন উত্তেজনা ও ভয় আপনার জন্য মারাত্বক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
– বিম, দেয়াল. কংক্রিটের ছাদ ইত্যাদির মধ্যে আপনার শরীরের কোন অংশ চাপা পড়লে বের হওয়ার সুযোগ যদি না থাকে তাহলে বেশি নড়াচড়া করবেন না, এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
আজ থেকে ন্যুনতম কিছু প্রস্তুতি নিন
– বিছানার পাশে জুতা, হেলমেট, হুইসেল রাখুন।
– ভারী আলমারি, ফ্রিজ, টিভি-দেয়ালে স্কু দিয়ে ফিক্স করে রাখুন।
– গ্যাস সিলিন্ডার চেইন বা স্ট্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখুন।
– ঘরের দরজা যেন অটো-লক না হয়- খেয়াল রাখুন।
– চাবি সবসময় হাতের কাছে রাখুন।
– জরুরি নাম্বারসমূহ পরিবারের সবার ফোনে সেভ করুন।
– একটি লাইন মনে রাখুন-
– ৪র্থ তলা বা তার উপরে থাকলে-দৌড়ানো মানে মৃত্যুর ঝুঁকি, আশ্রয় নিন। ১ম/২য় তলায় থাকলে- প্রথম ২০ সেকেন্ডই আপনার জীবন, দ্রুত বের হন।
প্রস্তুতি ছাড়া বাঁচা ভাগ্যের উপর। প্রস্তুতি থাকলে বাঁচা আপনার হাতে। প্রকৃতি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়-মানুষ ভঙ্গুর, কিন্তু সচেতনতা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
একটু প্রস্তুতি, একটু জ্ঞান-অনিশ্চিত মূহুর্তে জীবন বাঁচাতে পারে। তাই ভূমিকম্পের করনীয় নিজে জানুন, অন্যকে জানান, সচেতন করুন, জীবন বাঁচান।।
লেখক: জি এম সাইফুল ইসলাম, তথ্য অফিসার, পিআইডি, চট্টগ্রাম