সকালের নরম রোদ বারান্দায় এসে পড়েছে। কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন শারমিন আক্তার। সামনে সাদা রঙের একটি পাঞ্জাবি—তার ওপর নীল রঙে ফুটে উঠছে পাতার অনবদ্য নকশা। তুলির কোমল টানে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে কাপড়ের প্রতিটি রেখা। একসময় যিনি ছিলেন কেবল ঘর-সংসার সামলানো এক সাধারণ গৃহিণী, সেই শারমিন আজ ‘হ্যান্ড পেইন্ট উদ্যোক্তা’ হিসেবে পরিচিত লোহাগাড়া–চরম্বার মাইজবিলা গ্রামে।
মাত্র পাঁচ বছর আগেও ঘরের কাজের ফাঁকে নিজের আনন্দের জন্য একটু আঁকাআঁকি করতেন তিনি। এখন সেই আঁকাআঁকিই তাঁর পরিবারের আর্থিক শক্তি— মাসে আয় করছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। নিজ হাতে গড়া ব্র্যান্ড ‘Sharmin’s Hand Paint’ আজ বেশ পরিচিত নাম।
গল্পের শুরু সেই ঈদে
২০২০ সালে বিয়ে হয় শারমিন আক্তার ও পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুনের। বিয়ের পরের বছর ঈদের আগে স্বামীর জন্য কেনা একটি পাঞ্জাবিতেই প্রথম হাতের আঁচড়ে নকশা এঁকে দেন তিনি। সেই পাঞ্জাবিই যেন খুলে দিল নতুন এক স্বপ্নের দরজা।
এরপর তিনি নিজের হাতে তৈরি ১৫টি পোশাকে নকশা করে ছবি তুলে দেন ফেসবুকে। ফল চমকপ্রদ— এক সপ্তাহেই সব পোশাক বিক্রি। মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজির সেই উদ্যোগেই লাভ হয় প্রায় ৮ হাজার টাকা। এখান থেকেই শুরু তাঁর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার যাত্রা।
বারান্দার স্টুডিও’তেই স্বপ্ন বুনন
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, শারমিনের বাড়ির বারান্দাই তাঁর ছোট্ট কর্মশালা। এখানেই তিনি পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, বাচ্চাদের পোশাকসহ নানা ধরনের ড্রেসে নকশা ফুটিয়ে তোলেন। প্রয়োজনীয় কাপড় অর্ডার করে আনেন ঢাকার পোশাক কারখানা থেকে। কাজ শেষে ছবি তুলে পোস্ট করেন ফেসবুক পেজে। সেখান থেকেই অর্ডার আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
শারমিন আক্তার জানান, রং–তুলির কাজ আমার কাছে শিল্প। প্রতিটি পোশাক যেন আমার নিজের সন্তান। ভালোবাসা দিয়েই সাজাই। তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নারীরা ঘরবন্দী থাকলে সমাজ এগোয় না। শারমিনের প্রতিভা আমি শুধু তাকে সুযোগ দিয়েছি— সে নিজের পথ নিজেই তৈরি করেছে।’
প্রশাসনের নজরেও ‘সফল নারী’ শারমিন
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লোহাগাড়া উপজেলা কার্যালয়ের ক্রেডিট সুপারভাইজার মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘গ্রামের নারীরা চাইলে ঘরে বসেই উদ্যোক্তা হতে পারেন। শারমিন তার প্রমাণ। আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ ও ঋণসহ সহযোগিতা দেওয়া হবে। সফল উদ্যোক্তাদের জয়িতাও করা হবে।’
স্বপ্ন এখন আরও বড়
মাসে প্রায় ৫০টি পোশাক পেইন্ট করেন শারমিন। ভবিষ্যতে বড় পরিসরে নিজের একটি ‘হ্যান্ড পেইন্ট স্টুডিও’ খুলতে চান। সেখানেই প্রশিক্ষণ দিতে চান গ্রামের মেয়েদের।আত্মবিশ্বাসে ভরা কণ্ঠে শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমি চাই, আমার মতো আরও মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াক।’