বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, মাইজভাণ্ডারি তরিকার মূল নির্যাস মানবকল্যাণ। এ তরিকা মানুষকে আলোর পথ দেখায়।তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে দেশে-দেশে যুদ্ধ-সংঘাত, ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবৈষম্য, ইসলামোফোবিয়া, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করেছে। এ অশান্ত পরিস্থিতিতে হুজুর গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি (কঃ)’র মহৎ আদর্শ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা, মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ, সমতা সৃষ্টির শিক্ষা মাইজভাণ্ডার শরিফ দিয়ে আসছে, তাই মাইজভাণ্ডারি দর্শনই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ার মূল প্রভাবক হতে পারে।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দমদমায় গাউছিয়া গনি মনজিলে পীরে কামেল হযরত আল্লামা শাহসুফি সৈয়দ আবদুল গনি চৌধুরী (ক:)-এর ৯১তম ওরশ শরিফ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এসব বলেন।
প্রফেসর শাহসুফি সৈয়দ সফিউল গনি চৌধুরী মাইজভাণ্ডারি (মা.জি.আ)’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় ‘আল্লামা শাহসূফি সৈয়দ আবদুল গনি চৌধুরী মাইজভাণ্ডারি (ক.)’র সাহিত্য প্রতিভা ও চিন্তাদর্শন’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মো. নূরে আলম।
স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাহজাদা সৈয়দ কাদের গনি চৌধুরী।
আলোচনায় অংশ নেন ড. নিজাম উদ্দিন জামি, মাওলানা সৈয়দ মু‘তাসিম বিল্লাহ, শাহসুফি সৈয়দ মামুনুর রশিদ আমিরী, শাহসুফি শেখ শহিদুল্লাহ ফারুকী, মাওলানা কাজী খালেদুর রহমান হাশেমী, মাওলানা সৈয়দ সালাউদ্দিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহজাহান, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম, মাওলানা আবুল বশর মাইজভাণ্ডারি, মাওলানা সৈয়দ বশিরুল আলম, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফোরকানী, মাওলানা আলী আজম রেজভি, মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ এনামুল হক, মাওলানা নজরুল ইসলাম আশরাফি, মাওলানা কে. এম. জহির উদ্দিন, মাওলানা কাজী সেলিম উদ্দীন, মাওলানা ইকরাম উদ্দিন, হাফেজ মাওলানা বেলাল উদ্দিন, মাওলানা মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন প্রমুখ। বাংলাদেশের জনগণ ও মুসলিম উম্মার সুখ-সমৃদ্ধি এবং বিশ্ব শান্তি কামনা করে মোনাজাত পরিচালনা করেন সাজ্জাদানশীনে দরবার প্রফেসর শাহসুফি সৈয়দ সফিউল গনি চৌধুরী।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার একত্ববাদে বিশ্বাস করার জন্য। আল্লাহর একত্ববাদে যিনি বিশ্বাস করেন না তিনি ঈমানদার নন। মাইজভাণ্ডারি তরিকা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে চলে। কোরআন-সুন্নাহর মধ্যে যা আছে, তা-ই তরিকায়ে মাইজভাণ্ডারির মধ্যে নিহিত। এর বাইরে যা মাইজভাণ্ডারি তরিকা সেটিকে অনুমোদন করে না।
তিনি বলেন, মাইজভাণ্ডারি তরিকা একটি সুফি পথ যা শান্তি, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের ওপর জোর দেয় এবং এটি ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস ও নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই তরিকাটি কোরআন ও হাদিসভিত্তিক এবং এটি আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সম্প্রীতি অর্জনের একটি সহজ পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। মাইজভাণ্ডারি তরিকতপন্থীরা মারামারি, হানাহানি ও রক্তপাতকে সমর্থন করে না।
বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, বৈচিত্র্যময় মাইজভাণ্ডারি দর্শনের গভীরতা মহাসাগরের চেয়েও গভীর। তীরে দাঁড়িয়ে যেমন মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করা যায় না; তদ্রূপ-মাইজভাণ্ডার না গিয়ে এ দর্শনের গভীরতা বোঝা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন অনুভূতি ও উপলব্ধি। এর গভীরতা সম্পর্কে শাহানশাহ্ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভাণ্ডারি বলেছেন, ‘Maizbhandar is an Ocean. Don’t think otherwise.’ এটি এমন এক পবিত্রময় স্থান, যেখানে আউলিয়াগণ প্রতিনিয়ত নৃত্যেরত থাকেন।
তিনি বলেন, মহান আল্লাহ প্রেরিত পবিত্র কোরআন এবং প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) জীবনাদর্শের অমূল্য অনুষঙ্গগুলোকে যথার্থ ধারণ-অনুসরণ-পরিচর্যার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন মাইজভাণ্ডারি দর্শনের মৌলিক ভিত্তি। উপমহাদেশের প্রধান আধ্যাত্মিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ। এটি কেবল একটি দর্শন। পারলৌকিক সাধনা কিংবা চেতনার নাম নয় বরং একটি মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক এবং বিচারসাম্যমূলক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম। এ দর্শন সব ধরনের গোঁড়ামি ও মানবতাবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব। মাইজভাণ্ডার দর্শনে ধর্ম সাম্যের যে বাণী তার যথার্থ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় এর প্রবর্তক শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারির (ক.) কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর সবাইকে নিজ নিজ ধর্মে থেকে কাজ করার ও আল্লাহকে স্মরণ করার পরামর্শ দিতেন। সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে তার কর্মকাণ্ড সব সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করে। ফলে ধীরে ধীরে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ সব ধর্মের মানুষের অপরূপ মিলন কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়।
কুপ্রবৃত্তি বন্ধ করে রুহে ইনসানির সুপ্রবৃত্তি জাগ্রত করার জন্য হজরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি (ক.) নির্বিঘ্ন ও সহজসাধ্য মাধ্যম হিসেবে তরিকার উসুলে সপ্তপদ্ধতির প্রবর্তন করেন, যা দুই স্তরে অনুশীলিত হয়। প্রথম স্তর হচ্ছে ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ আর দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে মউতে আরবা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু। ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর হচ্ছে- ফানা আনিল খাল্ক্ক (পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা), ফানা আনিল হাওয়া (অনর্থক কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা) ও ফানা আনিল এরাদা (নিজ ইচ্ছা বাসনাকে খোদার ইচ্ছায় বিলীন করে তাসলিম ও রজা অর্জন করা)।
অপরদিকে মউতে আরবা হলো— মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যু (উপবাস-সংযমের মাধ্যমে অর্জিত এই মৃত্যুতে মানবমনে উজ্জ্বলতা ও আলো দেখা দেওয়া)। মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যু (সমালোচনায় বিরক্ত বা রাগান্বিত না হয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে সংশোধনের মনমানসিকতা অর্জনই কালো মৃত্যু), মউতে আহমর বা লাল মৃত্যু (কামস্পৃহা ও লোভ-লালসা থেকে মুক্তিতে হাসিল হওয়া) ও মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু (নির্বিলাস জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে সবুজ মৃত্যু লাভ হওয়া)। এই কোরআনি হেদায়াতের সপ্তপদ্ধতি মানবজীবনের এক নিখুঁত সহজ-সরল ও স্বাভাবিক পন্থা, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনে।