শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫

লোহাগাড়ার জনপদের জলাশয়ে বিলুপ্তির শঙ্কা

মৎস্য চাষের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা

লোহাগাড়া প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৮

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লোহাগাড়া। পাহাড়, টিলা, অরণ্য আর ঝরনার সুরে সাজানো সবুজ-শ্যামল জনপদ। পুকুর-দিঘী, খাল-ছড়া আর জলাশয়ে ভেসে থাকা শাপলা-শালুকের অপরূপ দৃশ্য এই অঞ্চলের সৌন্দর্যের সঙ্গে ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একসময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি জলাশয়েই ফুটত জাতীয় ফুল শাপলা— যা ছিল গ্রামের মানুষের আনন্দ, শিশুর খেলাধুলা, পাথেয় এবং ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক।

কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই চিরচেনা দৃশ্য আজ অতীত হয়ে গেছে। আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণের কারণে লোহাগাড়ার জনপদের জলাশয়গুলো এখন শাপলাবিহীন। জলজ উদ্ভিদ টিকে থাকার যে স্বাভাবিক পরিবেশ, তা সরাসরি বিপর্যস্ত হচ্ছে মাছ চাষের উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে।

শাপলা শুধু একটি ফুল নয়— এটি বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও লোকজ জীবনের গভীরে প্রোথিত আবেগ। গ্রামের শিশুরা সাঁতার কেটে শাপলা তুলত, খেত কাণ্ডের রস, বানাত খেলনা। বাজারে বিক্রি হতো শাপলার কুঁড়ি, রান্না হতো ঘরের খাবার হিসেবে। এক সময় শাপলা ফুলের সৌরভে দুলত পুরো গ্রামবাংলা— আজ সেই দৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় খুব কম।

উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের বার আউলিয়া কলেজসংলগ্ন একটি জলাশয় এখনো জীবন্ত স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বর্ষার মৌসুমে ভেসে ওঠা শাপলা পথচারী, শিক্ষার্থী এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের মন কাড়ে। নরম হাওয়ায় ভাসতে থাকা ফুলের কাঁপুনি যেন জানিয়ে দেয়, ‘আমরা এখনো আছি, যদিও সংখ্যায় খুব কম।’

কলেজের শিক্ষার্থী রায়হান সাকিব বলেন, ‘গ্রামে আগে শাপলা দেখা যেত সর্বত্র। এখন আধুনিক মৎস্য চাষের কারণে পুকুর-দিঘী থেকে শাপলা প্রায় বিলুপ্ত। কলেজ সংলগ্ন জলাশয়ের ফুটন্ত শাপলাগুলো আমাদের পুরনো দিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।’

উন্নত জাতের মাছ চাষ, পুকুর সংস্কার, পানি গভীর ও চলাচলহীন করে রাখা, নিয়মিত ঔষধের ব্যবহার— সব মিলিয়ে শাপলা-শালুকসহ সব ধরনের জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সব উদ্ভিদ পানির স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য ধরে রাখে, জলজ প্রাণীর আবাসস্থল তৈরি করে। এগুলো নষ্ট হলে পুরো জলজ পরিবেশ বিপন্ন হয়।

স্থানীয় পরিবেশ সচেতনরা মনে করেন, জলাশয়গুলোতে পরিকল্পনাহীন আধুনিক মাছ চাষ প্রকৃতি থেকে শাপলা শুধু সরাচ্ছে না; ধ্বংস করছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাশয়ে কিছু অংশ শাপলা-শালুক সংরক্ষণের জন্য উন্মুক্ত রাখা, ঔষধ ব্যবহারে সতর্কতা এবং পরিবেশবান্ধব মৎস্য চাষকে উৎসাহিত করলেই শাপলা আবার ফিরে আসতে পারে। যথাযথ উদ্যোগ নিলে লোহাগাড়ার হারাতে বসা এই জলজ ঐতিহ্য নতুন প্রাণ পেতে পারে— ফুটে উঠতে পারে গ্রামের জলাশয়ে একদা স্বাভাবিক সেই নীরব সাদা-গোলাপি শোভা।

লোহাগাড়ার জলাশয়ে ফুটন্ত শাপলার সেই সৌন্দর্য আজ স্মৃতির পাতায়। যদি এখনই সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্ম জানবে না— বাংলার এই প্রকৃতির রূপ কেমন ছিল, কীভাবে শাপলা ফুটে ভাসত গ্রামের পুকুর-দিঘীতে।

ভিডিও