শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

ডেঙ্গুর ধরনে ভয়াবহ পরিবর্তন, সামান্য জ্বরেই শকে মৃত্যু

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ : ২ নভেম্বর ২০২৫, ০১:১২

রাজধানীতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ নতুন মাত্রা নিচ্ছে। সামান্য জ্বর থেকেই রোগীরা দ্রুত গুরুতর অবস্থায় চলে যাচ্ছেন, এমনকি মৃত্যু ঘটছে কয়েক দিনের মধ্যেই। চিকিৎসকরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট আগের তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।

মিরপুরের গৃহবধূ সালমা বেগম (৩৫) প্রথমে হালকা জ্বরে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ফের জ্বর আসে। দ্রুত রক্তচাপ কমে যায়, প্লাটিলেট নেমে যায় বিপজ্জনক মাত্রায়। আইসিইউতে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৮ অক্টোবর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মারা যান তিনি। একই পরিণতি হয় ডেমরার তরুণ হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকীর (২৫)। বিদেশে পড়াশোনার প্রস্তুতি নিতে থাকা এই তরুণ সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দ্রুত শকে চলে যান এবং শেষ পর্যন্ত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

চিকিৎসকদের মতে, এবারের ডেঙ্গু ভ্যারিয়েন্ট শরীরে খুব দ্রুত প্রভাব ফেলছে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ইমরান হোসেন মালিথা বলেন, “রোগীরা প্রথমে হালকা জ্বরে অসচেতন থেকে যান। কিন্তু শরীরের ভেতরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ও প্লাটিলেট মারাত্মকভাবে নেমে যাচ্ছে। একবার শকে চলে গেলে রোগীকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার ৫১৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭৮ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬২ শতাংশ এবং মৃতদের ৫৩ শতাংশই পুরুষ।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশের মৃত্যু ঘটেছে ভর্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে, আর ৪৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে প্রথম ২৪ ঘণ্টায়। চিকিৎসকদের ধারণা, হাসপাতালে আসতে দেরি করায় ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টে সামান্য ভুলের কারণেই মৃত্যুহার বাড়ছে।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি বছর ২,৬৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, মারা গেছেন ৩৯ জন। হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীই যাত্রাবাড়ী, মান্ডা, বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা। চিকিৎসকদের মতে, অনেক রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, ফলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে শকে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “এখন বেশিরভাগ রোগী এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে ভুগছেন, যা একসঙ্গে লিভার, কিডনি ও হৃদযন্ত্রে আঘাত করছে। জ্বর দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা ও তরল গ্রহণই এখন সবচেয়ে জরুরি।”

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য দিলেও কতজন পরীক্ষা করছেন বা শনাক্ত হচ্ছেন— সে তথ্য নেই। এজন্য ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্রও অজানা থেকে যাচ্ছে। গত বছর এ উদ্দেশ্যে একটি সফটওয়্যার তৈরি হলেও এখনো চালু হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর আচরণ পরিবর্তনে আক্রান্তদের দ্রুত শনাক্ত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “ডেঙ্গুর বর্তমান ধরন এমন যে, আক্রান্ত হলেও বোঝা যায় না। তাই শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার।”

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুর এই নতুন রূপ কেবল চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই নয়, সচেতনতাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তাই হালকা জ্বর হলেও দ্রুত পরীক্ষা, পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ ও সময়মতো চিকিৎসাই এখন জীবন বাঁচানোর মূল উপায়।

ভিডিও