রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর চট্টগ্রামের রাউজানে ১৭ জন এবং রাঙ্গুনিয়ায় ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিরোধের জেরে ঘটেছে।
গত বছরের ২৮ আগস্ট রাউজানে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আব্দুল মান্নান নামের একজনকে। ১ সেপ্টেম্বর মো. ইউসুফ মিয়া, ২৯ অক্টোবর আজম খান ও ১১ নভেম্বর পাওয়া যায় আবু তাহেরের লাশ। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পিটিয়ে হত্যা করা হয় মুহাম্মদ হাসানকে। ১৫ মার্চ ছুরিকাঘাতে নিহত হন কমরউদ্দিন জিতু। ২১ মার্চ পিটিয়ে হত্যা করা হয় মো. রুবেলকে। ৪ এপ্রিল খুন হন প্রকৌশলী নূর আলম বকুল। ১৭ এপ্রিল মো. জাফর নামের একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৯ এপ্রিল রাতে গুলি করে এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আবদুল্লাহ মানিককে। ২২ এপ্রিল দোকানে ডেকে এনে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় ইব্রাহিমকে। গত ৬ জুলাই স্ত্রী-কন্যার সামনে মো. সেলিম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে বোরকা পরিহিত অস্ত্রধারীরা। ৭ অক্টোবর পাহাড়তলী এলাকায় আবদুল হাকিম নামের এক ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেলযোগে আসা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। ১৮ দিনের মাথায় ২৫ অক্টোবর দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন মুহাম্মদ আলমগীর আলম (৪৫) নামের যুবদল কর্মী।
রাউজান থানা সূত্রে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, মাটি-বালুর ব্যবসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে খুনোখুনি বেড়েছে। নিহত ১৭ জনের মধ্যে ১৩ জন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। এসব ঘটনায় ৩৫০ এর বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। মামলা করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। তবে আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা খুবই কম বলে জানিয়েছেন মামলার বাদীরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রাউজানে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। অনেক হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। এছাড়া পারিবারিক সমস্যায় হত্যাগুলো তাৎক্ষণিক হচ্ছে। অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যতটা সহজ, হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ ততটা সহজ নয়। তবে সব হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান আছে।
রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের ঠাণ্ডাছড়ি নতুনপাড়ায় গত ১৫ জানুয়ারি ভোরে হত্যার শিকার হন গৃহবধূ জরিনা বেগম (২৪)। মামলার পর পুলিশ তার স্বামী শাহ আলম ওরফে হাসানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। ২৫ মার্চ সরফভাটার মীরেরখিল বাজারে নিজ দোকানে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে নুরুল ইসলাম তালুকদার (৭০)-কে। এ ঘটনায় মামলা হয়নি। গত ১০ এপ্রিল ভোরে সরফভাটা-বোয়ালখালী সীমান্তে লেমুছড়া এলাকায় গুলিতে নিহত হন আওয়াইমং মারমা (৩৩)। লেবুবাগান পাহারা দিতে গেলে তাঁকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।
৬ জুন দুপুরে গোডাউন গরুর বাজারে শ্বশুর ওসমান গণিকে (৫০) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে জামাতা হোসেন। ২০ জুন সরফভাটা ইউনিয়নের কাইন্দারকুল এলাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার সময় লেবু বিক্রেতা শিবুই মারমাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার বা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পদুয়া ইউনিয়নের মোবারক আলী টিলা এলাকায় ১০ জুলাই বিকেলে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে প্রবাস ফেরত মোহাম্মদ রাসেল (৩৫)-কে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার তিন মাস পরেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
পদুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হারুয়ালছড়ি ইকোপার্কের কাছে ২৭ আগস্ট রাতে দুর্বৃত্তরা রাঙ্গুনিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী রুবেল (৩৫) নামে এক যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারের বিরোধের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে পারুয়া ইউনিয়নে পাওয়া যায় গৃহবধূ রুমা আক্তারের (২৬) লাশ। স্বামী নেজাম কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যৌতুক চেয়েছিলেন। না পেয়ে রুমাকে হত্যা করেন। ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সরফভাটা ইউনিয়নের সিকদারপাড়ায় প্রতিবেশীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দিনমজুর রহমত উল্লাহ (৪৮)। ইট ভাঙানোর ২০০ টাকা মজুরি নিয়ে বিরোধে প্রাণ যায় তার। এ ঘটনায় দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত আশরাফ আলীকে গ্রেপ্তার করে। এ হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে লালানগর ইউনিয়নের মোগল তালুকদারপাড়া মসজিদের পাশে দুর্বৃত্তরা মো. খোরশেদ আলম (২৮) নামের এক যুবককে গলা কেটে হত্যা করে। তার বাবা আব্দুল খালেক বাদী হয়ে ১০-১২ জনকে আসামি করে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ মামলার প্রধান আসামি সাইফুল আজমকে গ্রেপ্তার করে।
২০২৪ সালের ৭ আগস্ট সুখবিলাস গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন আবদুল মজিদ (২৮)। জমি-সংক্রান্ত বিরোধে এ ঘটনা ঘটে। ২ ডিসেম্বর রাতে সরফভাটায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন প্রবাসী সেকান্দর চৌধুরী মামুন (৪২)। ২৬ ডিসেম্বর রাতে লালানগর ইউনিয়নের ইসলামিয়াপাড়ায় গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়ার সময় রবিউল হোসেন রুবেল (২৬) নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১৮ আগস্ট পুলিশ মাদ্রাসাছাত্র ইমরান নবী জুয়েলের (১৬) লাশ উদ্ধার করে।
দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম জানান, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে। কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মাদক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এই থানা দুজন এসআই দিয়ে চালাতে হচ্ছে। তারপরও আসামি গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ওসি এটিএম শিফাতুল মাজদার বলেন, মামলা নথিভুক্ত করার পর জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, পুলিশ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করছে। তারা সতর্ক অবস্থানে আছে। রাউজান-রাঙ্গুনিয়ার সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কোনো ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি পুলিশের সহায়তায় এগিয়ে আসতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।